অজ্ঞতার সংঘর্ষ মোকাবেলায় |শফিক ভিরাণী| TEDxUTSC

মজাদার কাহিনী, বিস্ময়কর তথ্য-উপাত্ত এবং হৃদয়বিদারক ব্যক্তিগত ঘটনাসহ একটি ভাবতান্ত্রিক অগ্রগামী পথের মাধ্যমে ড. ভিরাণী আমাদের একটি উন্নততর ভবিষ্যতের আশা করার অনুপ্রেরণা দেন।

টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি শিক্ষার বিশিষ্ট অধ্যাপক, দক্ষিন এশিয়ার সভ্যতা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, এবং ঐতিহাসিক শিক্ষা বিভাগের প্রাক্তণ সভাপতি হিসেবে ড. শফিক এন. ভিরাণী একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বক্তা, যিনি পঞ্চাশটিরও অধিক দেশে পনের হাজারেরও বেশী দর্শককে বক্তৃতা করেছেন। তাঁর “মধ্যযুগের ইসমাইলীঃ উদ্বর্তনের ইতিহাস, মুক্তির অনুসন্ধান গ্রন্থটি যেকোন বড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের প্রথম কোন শিক্ষাক্ষেত্রের বই, যার নিজস্ব আনুগমিক বই আছে। মানব কল্যাণ ও জ্ঞানের সীমান্ত সম্প্রসারণের প্রচেষ্টায় আত্ম-নিবেদনের জন্য জাতিসংঘ তাঁকে “একজন স্বপ্নাচারী” হিসেবে আখ্যায়িত করে সম্মানিত করেছে।

এই বক্তৃতাটি টেড সম্মেলনের নীতিমালা অনুসরণ করে টেড-এক্সে প্রদান করা হয়েছিল, কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে স্থানীয় সম্প্রদায়ে আয়োজন করা হয়েছিল। আরও তথ্যের জন্য দেখুন: http://ted.com/tedx

আমি এইমাত্র বিমান যোগে টেড সম্মেলনে আসলাম,

আর যখন আমি বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলাম

তখ্ন আমার এক পারিবারিক বন্ধুর সঙ্গে
দেখা হয়ে গেল, যাকে বহুদিন দেখিনি

আমরা তাকে আনোয়ার চাচা ডাকি

তিনি দেখতে কানাডার জনপ্রিয় টিভি কৌতুক
বিশাল প্রান্তরে ছোট মসজিদ

নাটকটির বাবর চরিত্রটির মতো।

(হাসি)

তিনি প্রচলিত কোর্তা-পাজামা পরতে ভালবাসেন

তিনি দাড়ি রাখেন, আর তার রয়েছে
সবচেয়ে প্রিয় পাকিস্তানি উচ্চারণ।

তাই তিনি ছুটে এসে আমাকে
এক লম্বা আলিঙ্গন দিলেন

আর বললেন, “কেমন আছো?
আজকাল কী করছো তুমি?”

বললাম, আমি ইসলামি শিক্ষার অধ্যাপক

আর তাই দেশে-বিদেশে ঘুরি আর বক্তৃতা
দিয়ে থাকি

যাতে ইসলাম সম্পর্কে মানুষ কিছু জানতে পারে

বিশেষকরে নয়/এগারোর পর।

তিনি আমার চোখের উপর চোখ রেখে বললেন

“আমার কাছে নয়/এগারোর কথা বলো না” ।

যেখানেই যাই, সবাই আমার দিকে এমন করে তাকায়
যেন আমিই নয়/এগারোর জন্য দায়ী।

আমি? নয়/এগারোর জন্য দায়ী?

সেভেন-ইলেভেন হতে পারে, কিন্তু নয়/এগারো না

(হাসি) (করতালি)

আনোয়ার চাচাকে যা বললাম

আমি প্রচুর জায়গায় যাই ও বক্তৃতা দিয়ে থাকি

আর এর একটা হলো জাতীয় প্রেস ক্লাব।

সেসময় ডিএইচএম দ্রব্য নিয়ে খুব কথা চলছিল।

প্রকৃতপক্ষে, ইডাহোতে জরীপে অংশ নেয়া
শতকরা ৮৬ জন

এই দ্রব্যের নিষিদ্ধীকরণ চেয়েছিল।

এ দ্রব্য সম্পর্কে কয়েকটি বিশেষ তথ্য দিতে চাই

তারপর আপনাদের মতামত জানব।

আমি যেসব তথ্য আপনাদেরকে বলতে যাচ্ছি

তার সবই যথার্থ মূল্যায়নের পর
প্রকাশিত তথ্য

এবং সেরা বিজ্ঞানীদের দ্বারা যাচাইকৃত।

তাঁরা হার্ভার্ড, এমআইটি, টরন্টো,
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের।

ডিএইচএম বর্ণহীন, গন্ধহীন ও স্বাদহীন।

ডিএইচএমের দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতি মানবদেহের
টিস্যু মারাত্মকভাবে ক্ষতি করে।

ডিএইচএমের লক্ষণসমূহ হলো অত্যধিক
ঘামা, প্রসাব

পেটফাঁপা, বমি, বমনেচ্ছা এবং তাপমাত্রার
ভারসাম্যহীনতা।

মারাত্মকভাবে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের
টিউমারে ডিএইচএম পাওয়া গিয়েছে।

দূর্ঘটনাক্রমে ডিএইচএম -এর প্রশ্বাস

বিশ্বব্যাপী প্রধান তৃতীয় অনিচ্ছাকৃত
মৃত্যুর কারণ।

বছরে প্রায় ৪ লক্ষ মারাত্মাক মৃত্যু ঝুঁকিতে

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে।

যারা এর প্রতি আসক্ত

ডিএইচএম-এর প্রত্যাহার মানেই নিশ্চিত মৃত্যু

এ তথ্যের ভিত্তিতে আপনাদের কয়জন ডিএইচএমের
মুক্ত বিচরণ সমর্থন করেন?

প্রায় কেউ-ই না।

আপনারা ঐসব মানুষদের সঙ্গে একমত

যাদের সঙ্গে জাতীয় প্রেস কাউন্সিলে
আমি কথা বলেছি।

এ সম্পর্কে আর একটু কিছু বলা যাক।

ডিএইচএম হলো ডি-হাইড্রোজেন মনোক্সাইড

এটা হাইড্রোজেন হাইড্রোক্সাইড নামে পরিচিত।

কিন্তু আমাদের অধিকাংশই এটাকে সাধারণ
নামে চেনে

তা হচ্ছে পানি।

আমি যে তথ্য দিয়েছি তার প্রতিটি

বিশ্বের নামি দামি বিজ্ঞানীদের দ্বারা
যাচাইযোগ্য।

তারপরও এই দর্শকদের প্রায় সবাই

পানির ব্যবহার সীমিত করতে
প্রস্তুত ছিলেন।

যখন আমাদেরকে তথ্যের একাংশ জানানো হয়

আমরা বিচারে বিভ্রান্ত হই ও ভুল সিদ্ধান্ত
নিতে বাধ্য হই।

ডিএইচএমের গল্প অনেককিছু প্রকাশ করে

আমি যে বিষয়ে বলব তা সম্পর্কে।

আর একধরণের ডিএইচএম আছে,
যা এর থেকেও ভয়াবহ।

প্রথম ডিএইচএম হলো ডি-হাইড্রোজেন মনোক্সাইড

আর দ্বিতীয়টি হলো ডি-হিউম্যানিজিং মুসলিম।

গণমাধ্যমের সৃষ্টি,

কৌশলী সাংবাদিকতা বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে
বিশ্বের অন্যতম একটি সংস্থা

মুসলমানদের সম্পর্কে প্রায় ১০ লক্ষ বিষয়ে
পর্যালোচনা করে

আমেরিকা ও ইউরোপের গণমাধ্যমে।

৯৮ শতাংশ গল্পই ছিল জঙ্গি মুসলমান নিয়ে।

মাত্র ২ শতাংশ ছিল ১৫০ কোটি সাধারণ
মুসলমান নিয়ে

যা আমাদের বিশ্ব জনগোষ্ঠির এক চতুর্থাংশ।

যারা আমাদের মতো এ গ্রহের অংশীদার।

ডিএইচএম সম্পর্কে আমি যে তথ্য দিলাম
তার সঙ্গে এ অবস্থা মিলে যায়।

যখন আমাদের সকল তথ্য একটি অস্বাভাবিক
গৌণ বিষয়ে থাকে

তখন কেবল ঐ গৌণ বিষয়টিই বুঝতে ব্যর্থ হই না,

পুরা বিষয়টি সম্পর্কে বরং আমরা
সম্পূর্ণ ভুল বুঝে থাকি ।

আমরা গুলিয়ে ফেলেছি

বিশ্বের ক্ষুদ্র একটি মুসলমান
জনগোষ্ঠির কাজকে

বিশ্বের ১৫০ কোটি মুসলমানের সঙ্গে।

এটা ঐ ঘটনার অনুরূপ, যদি কু ক্লাক্স
ক্লান-এর কাজকে আমলে নিয়ে

জ্বালানো-পোড়ানোকে বলা

“এই হলো সকল খৃস্টানদের প্রতিনিধি”।

দুর্ভাগ্যক্রমে, এ ধরণের গোঁজামিল
ক্রমান্বয়ে সাধারণ হয়ে গেছে।

যেমন আমরা এই পিক-আপ ট্রাকের পিছনে
লেখাটা দেখি, যেখানে লেখা হয়েছে,

“ইসলাম সম্পর্কে আমার যাকিছু জানার ছিল,
তা জেনেছি নয়/এগারোর দিনে”।

নয় /এগারোর কথা আমার খুব স্মরণ আছে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার
সবেমাত্র চাকুরী হয়েছে,

এবং আমি প্রথম ক্লাসের জন্য প্রস্তুতি
নিচ্ছিলাম।

সে ক্লাসের কথা মনে আছে।

ছাত্র/ছাত্রীরা ও আমি বোঝার খুব
চেষ্টা করলাম

ঐ ভয়ঙ্কর ঘটনা যা আমরা সবাই প্রত্যক্ষ
করলাম।

আমি সত্যিই আশাব্যাঞ্জক যা পেলাম

তা হলো সবাই মুক্তমনের অধিকারী এবং
তারা শিখতে ও বুঝতে ইচ্ছুক।

তারা অনুভব করল যে, তাদের সমগ্র শিক্ষাজীবনে

ইসলামি জগত সম্পর্কে তাদের প্রায় কোন
জ্ঞানই নেই।

আর,তাই, তারা বুঝতে চাইল।

তারা এ বিশ্বকে দেখতে চাইল এর প্রকৃতরূপে।

ট্রাকের পিছনের কথা আর এই ছাত্র/ছাত্রীদের
মধ্যে বৈপরীত্য

আমার মনে করিয়ে দেয়, একটা বইয়ের উক্তিকে,
যেটি আমি বর্তমানে অনুবাদ করছি।

বইটির বিখ্যাত লেখক হলেন নাসিরুদ্দিন তুসি,

যিনি অন্যতম একজন মুসলমান বিজ্ঞানী

এবং মধ্যযুগের একজন অন্যতম দার্শনিক।

উক্তিটি হলো,

“যে জানে না এবং সে জানে না যে,
সে জানে না, সে বোকা।

তাকে এড়িয়ে চল।

যে জানে না কিন্তু সে জানে যে,সে জানে না,
সে জ্ঞানান্বেষী।

তাকে শিখাও।

যে জানে এবং জানে না যে, সে জানে,
সে ঘুমন্ত।

তাকে জাগিয়ে তোল।

আর যে জানে এবং জানে যে, সে জানে সে জ্ঞানী।

তাকে অনুসরণ কর।”

আর একটা কারণে নয়/এগারো আমার
স্মৃতিতে দাগ কেটে আছে,

তা হয়ত অন্যান্যদের চেয়ে বেশীই হবে,

আর তা এই ছবিটা থেকে বলা যায়।

ইনি হলেন আমার চাচা, সালমান ধানী।

তিনি নিউইয়র্কে তাঁর সম্প্রদায়ে একজন সক্রিয়
স্বেচ্ছাসেবী ছিলেন;

কজন প্রকৃত মানবতাবাদী, যিনি উন্নয়নশীল
বিশ্বে সাহায্য করছিলেন।

তিনি আয়ন বীমা নামে একটি কোম্পানীর
ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন

তার অফিস ছিল ৯৯তম তলায়

বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের দক্ষিণ টাওয়ারে।

ঐ নির্দিষ্ট দিনটিতে

যখন ঐ প্লেনগুলো ঐ ভবনগুলিতে আঘাত হানে

তনি তাঁর সহকর্মীদের সরিয়ে নেয়ার
দায়িত্বে ছিলেন।

তিনি ৮০ জন সহকর্মীর জীবন বাঁচান,
যারা নিরাপদে বের হয়ে যায়।

কিন্তু ততোক্ষণে তাঁর নিজের জন্য
বেশী দেরী হয়ে যায়।

তিনি আটকে পড়েন।

এবং আজ তিনি ধ্বংসস্তুপের নীচে শায়িত

যা ছিল একসময় বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র

তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩

এ ছবিটা তোলা হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর
কিছুদিন আগে

যখন আমার পরিবারের সদস্যরা

আমার চাচা নিজার, চাচী মমতাজ এবং চাচাত
বোন ফাতিমা তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন

এবং তারা জাতিসংঘ ভবনের বাইরে
এই ছবিটি তুলেছিলেন।

এরা হলেন সাধারণ মুসলমান,
যাদের খবর আমরা কখনও শুনিনা।

জ্ঞানের যে শুন্যতা আমাদের আছে

মানবতার এক চতুর্থাংশ -
মুসলমান বিশ্ব সম্পর্কে

তা এক জরীপে বের হয়ে এসেছে,
যা গত মাসে প্রকাশিত হয়েছে

আমেরিকার অন্যতম এক জরীপ সংগঠনের দ্বারা

পাবলিক পলিসি পোলিং।

এক হাজার আমেরিকার নাগরিকের সাক্ষাতকার নেয়
এরা ডেমোক্রাট ও রিপাবলিকান উভয়

এবং ফলাফলটা আমি শপথ করে বলতে পারি

আমার মতো করে বানাতে পারতাম না,
চেষ্টা করলেও।

এক চতুর্থাংশ আমেরিকার জনগণ আগ্রাবাহকে
বোম মেরে উড়িয়ে দেয়ার পক্ষে।

(হাসি)

এখন, আপনারা যারা জানেন না-
আগ্রাবাহ হলো কাল্পনিক রাজ্য

চিরায়ত আলাদিনের ডিজনি থেকে নেয়া।

(হাসি) (করতালি)

এটা শঙ্কিত করে যে, এক চতুর্থাংশ জনগণ

একটা কাল্পনিক সামাজ্র্যকে বোমা মেরে
উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল

হয়ত এ কারণে যে, এটি মধ্যপ্রাচ্যের
কোন এক স্থানে অবস্থিত।

কিন্তু আমার মনে হয় এ বিষয়টা একটু ফলপ্রদ,
নয়কি?

কারণ, যে চিত্র সাধারণ জনগণ সম্পর্কে আছে

যারা দুনিয়ার এমন এক অংশে বাস করে,
যা কিনা কাল্পনিক, নয়কি?

আর এটা হলো তাই, যা বংশ
পরম্পরায় বৃদ্ধি পেয়েছে

বস্তুত: এটা হয়ত পূর্ব থেকে জ্ঞাত

যে এটা আলাদিন থেকে নেয়া কাল্পনিক
রাজ্য সম্পর্কে

কারণ যেসব প্রিয় ছবি দেখে আমি বড় হয়েছি,
ওটা তার একটি

এবং ভাষ্যকারের প্রথম গানটি আমার
খুব মনে পড়ে।

তারা গাইলো, “ও আমি এক দেশ থেকে এসেছি,
বহু দূরের দেশ।

যেখানে উটের সারি চরে বেড়ায়,

যেখানে তারা আমাদের কান কেটে দেয়,
যদি চেহারা খারাপ হয়।

এটা বর্বরতা, কিন্তু তাতে কি,
এটা আমাদের দেশ।”

একেবারে কচি বয়স থেকেই ছোট শিশুরা শিখছে

যে, মুসলমান দেশের জনগণ বর্বর ও সহিংস।

এ বিষয়ে প্রফেসর জ্যাক শাইনের চেয়ে বেশী
গবেষণা আর কেউ করেনি।

তিনি প্রায় এক হাজার চলচ্চিত্র সমীক্ষা করেন

যেগুলো শত বছর ধরে হলিউডে তৈরী হয়েছে

এবং মাত্র ১২টি ছবি পেলেন

যেগুলো মুসলমান বা আরববাসীকে ভালো
বলে চিত্রিত করেছে।

বস্তুত, তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে,

যদি কোন চলচ্চিত্রে একটা পুরুষ মুসলমানের
চরিত্র থাকে

তবে, শতকরা ৯৫ ভাগ সম্ভাবনা আছে যে,
তাকে চিত্রিত করা হবে

সহিংস, লোভী বা অসাধু হিসেবে।

শতকরা ৯৫ ভাগ

স্যামুয়েল হান্টিংটনের মতো মানুষরা আমাদের
বিশ্বের বর্তমান অবস্থার বিবরণ দিয়েছেন

“সভ্যতার সংঘর্ষ” হিসেবে।

আরও সূক্ষ্ম চিন্তাবিদরা

যারা বিশ্বের অন্যান্য অংশ সম্পর্কে ভালো
জানেন ও উপলব্ধি করেন

তারা উপলব্ধি করেন যে, আমরা যার সম্মুখীন
তা হলো “অজ্ঞতার সংঘর্ষ”।

আমরা কিভাবে অজ্ঞতার সংঘর্ষের মুখোমুখী?

ধারণাটা এ রকম, যা ছড়িয়ে দেয়া যায়।

আমি প্রশাসনিক কাজে জড়িত

পূর্ব আফ্রিকার মাদ্রাসা শৈশবপূর্ব
কার্যক্রমের

যা এই এলাকার সবচেয়ে ক্ষুধাপীড়িত
এলাকায় অবস্থিত

ঐসব শিশুদের সাহায্য করে,
যাদের স্কুলে যাওয়া হয়না।

বছর তিরিশের আগে

এই এলাকার উপকূলীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের
নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা

সর্বজন শ্রদ্ধেয় আগা খানের নিকট আসেন

যাঁর পিতামহ প্রথম বহুগোত্রীয় স্কুল
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন

এই সমগ্র এলাকায়

জানতে চেয়েছিল তিনি (আগা খান) কচি শিশুদের
শিক্ষার ব্যাপারে সাহায্য করবেন কিনা

এই অনগ্রসর সম্প্রদায়গুলোতে।

তারপর সেই থেকে তারা একটি অভিনব
পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করেছেন

যা সিএনএন ও বিবিসি কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে

যা কোন একজন স্বাভাবিকভাবে যা চায়,
তার সববিষয়ে শিক্ষা দেয়।

কিন্তু এর বাইরেও

পাঠ্যসূচীর একটা মৌলিক অংশ

যা আমার শিশুরা, যা আপনার এই ছবিতে দেখছেন

খুব কচি বয়স থেকেই শিখে

তা হলো তারা অবশ্যই বিশ্বের ধর্মীয়
বহুত্ববাদের সঙ্গে পরিচিত হবে।

তারা বিভিন্ন ভাষা শিখবে।

বিভিন্ন গোত্র এবং বিভিন্ন উপজাতি ও
ধর্মীয় সম্প্রদায় সম্পর্কে।

যা তাদের গ্রাম, শহর, দেশ ও আমাদের বিশ্বের
সঙ্গে অংশগ্রহণ করে।

অন্যকথায়, এই ছোট ছোট শিশুরা এক
“বিশ্বতাত্ত্বিক নৈতিকতা” নিয়ে বড় হয়।

এখন, আপনাদের অনেকেই যেমন স্মরণ করতে
পারেন, ২০০৮-এর শুরুতে

কেনিয়া ভয়াবহ সহিংসতার সম্মুখীন হয়

যখন দেশব্যাপী নির্বাচন-পরবর্তী
সহিংসতা শুরু হলো।

ভয়ানক হত্যাকান্ড চলল।

কারণ রাষ্ট্রপতি মুওয়াই কিবাকীর সমর্থকরা

তার বিরোধী দলের সমর্থকদের বিরুদ্ধে
সংঘর্ষে লিপ্ত হলো।

কিকুয়ু, লুও, ক্যালেনজিন উপজাতিরা একে
অন্যকে হত্যা করল।

হাজার হাজার মানুষ নিহত হলো;
লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া হলো।

কেনিয়ায় আমাদের ৭৫টি স্কুলের সবকয়টি
বন্ধ হয়ে গেল।

আমরা ক্ষেপে গেলাম।

আমাদের স্কুলগুলো দেশের দরিদ্রতম এলাকায়
অবস্থিত ছিল

যে এলাকাগুলো সহজেই সহিংসতায় আক্রান্ত
হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

যখন আমাদের বোর্ডের পরবর্তী সভা ডাকা হলো

আমি তখুনি একটি রিপোর্ট তৈরীর জন্য
অনুরোধ করলাম

“আমাদের শিশুদের কী হলো?”

“আমাদের শিক্ষকদের কী হলো?”

“স্বেচ্ছাসেবীদের বাবা-মায়েরা ভালো আছেনতো?”

“আমাদের সংগঠনগুলো ঠিক আছে কি?”

“কতজন মারা গেছে?”

রিপোর্ট যখন বের হলো, আমরা পড়ে
হতবাক হলাম।

আমাদের সংগঠনের একটি স্কুলও

সহিংসতায় আক্রান্ত হয়নি।

একটিও না।

এবং আমি নিশ্চিত যে, এটা হয়েছে,
কারণ গত ৩০ বছর ধরে

এই শিশুরা তাদের প্রতিবেশী সম্পর্কে
জানতে জানতে বড় হয়েছে।

তাদের গোত্র, ভাষা, এবং সঙ্গীত
সম্পর্কে জেনেছে।

এবং তাদের চারপাশের প্রত্যেকের নৃত্য
সম্পর্কে জেনেছে।

আর জেনেছে তাদের চারপাশের জগত সম্পকে।

তারা বিদ্বেষ আর মনুষ্যত্বহীন করার
ভাইরাস থেকে মুক্ত।

যে কথা তারা প্রায়ই ছড়াতে চেষ্টা করেন।

ভাবতে পারেন, যদি সারা বিশ্বের
শিশুদের শিক্ষা দেয়া হত

যেভাবে এই শিশুদের শিক্ষা দেয়া হয়েছিল?

তাহলে ইরাক ও সিরিয়াতে যে উপদলীয় সহিংসতা
দেখছি, তা কি দেখতে হতো?

আমেরিকায় যে জাতিগত সমস্যা আছে, তা কি থাকত?

পাশ্চাত্য বিশ্বে যে ইসলামভীতি দেখছি,
তা কি থাকত?

আপনারা জানেন, পাশ্চাত্যে একজন শিক্ষিত
মানুষের সংজ্ঞা হলো

তারা স্যার আইজ্যাক নিউটন সম্পর্কে
কিছু বলতে পারবে।

মোজার্ট সম্পর্কে, নেপোলিয়ান সম্পর্কে।

কিন্তু আমরা খুবই চাপে পড়ব

পাশ্চাত্যের এমনকি উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে
অনেককে পেতে

যারা মুসলিম বিশ্বের তুল্যবস্তু সম্পর্কে
জানেন।

এ বাস্তবতা সত্ত্বেও

যে, বীজগণিত ও কলনবিধি (এ্যালগোরিদম)
আরবী থেকে এসেছে

বিশ্বের কিছু গর্ব করার মতো স্থাপত্য

যেমন তাজমহল মুসলিম সংস্কৃতি থেকে এসেছে।

এবং ইবনে সীনার “ক্যানন অব মেডিসিন”

শত বছর ধরে ইউরোপের ঔষধশাস্ত্রে উচুমানের
পাঠ্য বই হিসেবে চালু ছিল।

আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমে বৈশ্বিক
দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা দরকার

একেবারে শৈশব অবস্থা থেকেই।

যাতে আমরা যে বিশ্বে বাস করি তা
জেনে শিশুরা বড় হবে।

আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষগুলোকে জানুক।

জাতিসংঘের প্রবেশমুখে একটি পার্সী
কবিতা লেখা আছে

তের শতকের মুসলিম কবি সা’দি-ই সিরাজীর,
যিনি বলেন,

আদমের সন্তানরা একে অন্যের
অঙ্গ-প্রতঙ্গের মতো।

আদমের সন্তানরা একে অন্যের
অঙ্গ-প্রতঙ্গের মতো

কারণ তারা সবাই একই একক আত্মা
থেকে সৃষ্টি হয়েছে।

যখন কালের ঝড়ো হাওয়া কোন এক
অঙ্গে যন্ত্রণা দেয়

তখন অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কিভাবে
শান্তিতে থাকে?

আপনারা যারা অন্যের ব্যথা
অনুভব করেন না

তবে কোন্ সাহসে আপনি নিজেকে আদমের
সন্তান বলেন?

কোন্ সাহসে আপনি নিজেকে একজন
মানব সন্তান বলেন?”

আমরা যে এক মানব পরিবার এই অনুভূতি

আমাদের নিকট অতীতের কয়েকটি অনুপ্রেরণাকারী
ঘটনার জন্ম দিয়েছে।

গত কয়েক মাসে সন্ত্রাসী আক্রমনের ফলে

পাশ্চাত্যের কিছু উগ্রপন্থী লোক

ঐসব মুসলমানদের বিরোধী হয়ে পড়েছে।

যাদের ঐসব সন্ত্রাসী আক্রমনের
সঙ্গে কোন সম্পৃক্তা নেই।

আমরা নারীদের চলন্ত বাসের সামনে
ঠেলে দিতে দেখেছি

মসজিদ পুড়িয়ে দিতে দেখেছি

এবং শিশুদের স্কুলে শুকরের মাথা ছুড়ে ফেলতে

কিন্তু এসব যখন ঘটতে শুরু করল

এবং মুসলমানরা যখন তাদের সম্প্রদায়ের
বাইরে বের হতে ভীত হলে

অষ্ট্রেলিয়াতে চার ঘন্টার ব্যবধানে
দেড় লক্ষ টুইট বের হলো

যাতে লেখা “আমি তোমার সাথে চড়ব”।

“আমি তোমার সাথে চড়ব”।

আমরা তোমার সঙ্গে আছি।
তোমরা আমাদের সম্প্রদায়ের অংশ।

তোমাদের চিন্তার কিছুই নেই।

এই কয়েক সপ্তাহ আগে

আল-সাবাব জঙ্গিরা মানদেরার পথে
একটি বাসে আক্রমন করেছিল

সোমালিয়া ও কেনিয়ার সীমান্তে।

তারা বাস থেকে খ্রিস্টানদের
নামাতে চেয়েছিল

ঠান্ডা মাথায় হত্যা করার জন্য।

কিন্তু ঐ বাসের মুসলমানরা

খ্রিস্টান ভাই-বোনদের হত্যা করতে দেয়নি।

তারা সন্ত্রাসীদের বলেছিল,
“তোমার এই খ্রিস্টানদের নিতে পারবে না।”

“যদি তোমরা তাদের হত্যা করতে চাও,
তবে আমাদের সবাইকে হত্যা করো।”

ঐ সন্ত্রাসীরা এতই ভীত হয়েছিল যে,
তারা পালিয়ে যায়।

যদি আমাদের প্রতিবেশী সম্পর্কে
আমাদের জ্ঞান থাকে

যারা এই বিশ্বজগত গড়ে তুলেছে

তবে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সামর্থ
আমাদের হবে

যারাই অন্যদের মনুষ্যত্বহীনতা ও বিভক্ত
করার আশা করে।

কারণ, শিরাজের সা’দীর ভাষায়,
আমরা সবাই আদমের সন্তান

আমরা সবাই এক মানব পরিবার।

ধন্যবাদ।

(উল্লাস) (করতালি)