চার বছর আগে এখানে ছিলাম, মনে আছে, সে সময় এই বক্তৃতাগুলো অনলাইনে দেওয়া হত না; যতদূর মনে পড়ছে বাক্সে ভরে দেওয়া হত টেডস্টারদের, এক সেট ডিভিডির বাক্স, সবাই সেলফে তুলে রেখে দিত। এখনো সেখানেই আছে। (হাসি) ক্রিস আমাকে ফোন করেছিলো, আমার সেই বক্তৃতা দেওয়ার এক সপ্তাহ পর বলল, "ভাবছি বক্তৃতাগুলো আমরা অনলাইনে দেব। আপনারটাও দিই?" আমি বললাম, "নিশ্চয়ই।" আর আজ চার বছর পরে, আমার সেই বক্তৃতা নাকি দেখেছে চল্লিশ... মানে, ডাউনলোড করা হয়েছে চল্লিশ লক্ষ বার। তার মানে আমার তো মনে হয় মোটামুটি ২০ দিয়ে গুণ করলে কত জন দেখেছেন সেই সংখ্যাটা পাওয়া যেতে পারে। আর ক্রিসের বক্তব্য, চারিদিকে নাকি ভীষণ ক্ষুধা আমার ভিডিও-র। (হাসি) (হাততালি) ... আপনাদের পায় না ? (হাসি) এখন, সেই পুরো ঘটনাটাই ছিল একটা ভূমিকা যাতে আমি আপনাদের জন্য আর এক বার পেশ করতে পারি, তাহলে শুরু করি। (হাসি) আল গোর বলেছিলেন সেই TED কনফারেন্সেই যেটায় চার বছর আগে আমিও বলেছিলাম, বলেছিলেন পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে। আমি সেটা উল্লেখ করেছিলাম আমার আগের বক্তৃতার শেষে। সেই সূত্র ধরেই আমি শুরু করতে চাইছি কেননা সত্যি বলতে কি, সময় ছিল মাত্র ১৮টা মিনিট, হ্যাঁ, যা বলছিলাম ... (হাসি) দেখুন, আল গোর ঠিকই বলেছিলেন। মানে, আবহাওয়ার একটা বড়সড় বিপর্যয় সত্যিই চোখে পড়ার মত, আর আমার মনে হয় লোকে যদি এটা বিশ্বাস না করে, ওদের আরও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়া উচিত। (হাসি) কিন্তু আমি ভাবছি দ্বিতীয় একটা পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা, যেটা একই রকম মারাত্মক, যার উৎসগুলোও একই, আর একই রকম গুরুত্বের সাথে যা আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। আমি বলতে চাইছি -- আর এখন আপনি বলতেই পারেন, "দেখুন, আমি বেশ আছি। একটা পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে আছি; দ্বিতীয়টার আমার দরকার নেই।" কিন্তু এই বিপর্যয় প্রাকৃতিক সম্পদের নয়, যদিও আমি মনে করি সেটা আজ বাস্তব, বিপর্যয়টা মানব সম্পদের। আমি মনে করি, মূলতঃ, বেশ কিছু বক্তা গত কয়েকদিনে যেমন বলেছেন, যে, আমরা অপচয় করে চলেছি আমাদের প্রতিভার। অসংখ্য মানুষ তাদের জীবন যাপন করে চলেছে তাদের প্রতিভা সম্বন্ধে কোনো পরিষ্কার ধারণা ছাড়াই, অথবা আদৌ বলার মত কোন প্রতিভা আছে কিনা সেটা না জেনেই। বিভিন্ন ধরণের লোকের সঙ্গে আমার দেখা হয় যারা মনে করে না তারা কোন কিছু সত্যি ভাল পারে। আসলে, আমি পৃথিবীটাকে দুভাগে ভাগ করি এখন। জেরেমি বেন্থাম, উপযোগবাদের বিশাল দার্শনিক, একবার এই তর্ক জুড়ে দেন। তিনি বললেন, "জগতে দুরকমের মানুষ আছে, যারা জগতকে দু ভাগে ভাগ করে, আর যারা করে না।" (হাসি) আর হ্যাঁ, আমি করি। (হাসি) নানান ধরণের লোকের সঙ্গে আমার দেখা হয় যারা যে কাজটা করেন সেটা করে আনন্দ পান না। জীবনটাকে পার করে দেন সেই কাজে কোনক্রমে লেগে থেকে। যে কাজ করেন তা থেকে তেমন কোন আনন্দ পান না। আনন্দ পাওয়ার বদলে, বরং সহ্য করে যান। সপ্তাহটা শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করেন। কিন্তু আমি এরকমও লোকের দেখা পাই যাঁরা যা করেন ভালবেসে করেন অন্য কিছু করার কথা ভাবতে পারেন না। যদি ওঁদের বলেন, "এই কাজ আর করবেন না," ওঁরা আপনার কথাই বুঝতে পারবে না। কারণ তাদের কাজ তাদের পেশা নয়, সেটা তাদের পরিচয়ও। ওঁরা বলবেন, "কিন্তু এইটাই তো আমি। এই কাজ ছেড়ে দেওয়াটা বোকামো হবে,কারণ এই কাজটা আমার মনের সবচেয়ে কাছাকাছি।" অবশ্য অধিকাংশ লোকের ক্ষেত্রে এটা সত্যি নয়। আসলে, উল্টোটাই মনে হয় ঠিক। জোর দিয়েই বলা যায় খুব কম লোকের ক্ষেত্রেই এটা সত্যি। আর আমি মনে করি অনেকগুলো সম্ভাব্য ব্যাখ্যা আছে এটার। আর তার মধ্যে প্রধান হল শিক্ষা, কারণ শিক্ষা, একভাবে বলা যায়, দূরে ঠেলে দেয় অসংখ্য মানুষকে তাদের সহজাত প্রতিভা থেকে। আর মানব সম্পদগুলো প্রাকৃতিক সম্পদের মতই; অনেক সময়ই নীচে চাপা পড়ে থাকে। খুঁজে বের করতে হয়। ঠিক সামনেই ছড়ানো থাকে না। এমন সব পরিস্থিতি তৈরী করতে হয় যাতে তারা নিজেদেরকে প্রকাশ করে। এখন আপনারা ভাবতে পারেন শিক্ষাই তো সে কাজটা করে। কিন্তু প্রায়ই শিক্ষা সেটা করে না। পৃথিবী জুড়ে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার হচ্ছে এই মুহূর্তে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। সংস্কার এখন আর কোন কাজের নয়, কেননা সেটা হল একটা অকেজো কাঠামোকে জোড়াতালি দেওয়া মাত্র। যা আমাদের প্রয়োজন -- এবং যে শব্দগুলো বার বার উচ্চারিত হয়েছে গত কয়েকদিনে -- সেটা বিবর্তন নয়, বরং বিপ্লব, শিক্ষাক্ষেত্রে। এই ব্যবস্থাকে বদলে দিতে হবে অন্য কিছুতে। (হাততালি) অনেক বাস্তব চ্যালেঞ্জের একটা হল মৌলিক উদ্ভাবন শিক্ষাক্ষেত্রে। উদ্ভাবন কঠিন কাজ কারণ, এর মানে এমন কিছু করা যা মানুষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খুব সহজ মনে করে না। এর মানে যাকে আমরা স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে নিই তাকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া, যে সব জিনিস আমরা মনে করি স্পষ্টই প্রতীয়মান তাকে চ্যালেঞ্জ করা। একটা বিশাল সমস্যা সংস্কারের বা বদলে দেবার ক্ষেত্রে হ'লো কমন সেন্সের জুলুম -- সেই সব ব্যাপার যা মানুষ মনে করে, "এটা অন্য কোনভাবে করা যাবে না, কারণ এটা এভাবেই করা হয়"। আব্রাহাম লিঙ্কনের দারুণ এক উক্তি কয়েকদিন আগে পেয়ে গেলাম, এই মুহূর্তে ওঁকে কোট করলে আমার মনে হয় আপনারা খুশিই হবেন। (হাসি) ডিসেম্বর ১৮৬২-তে উনি এ কথা বলেন কংগ্রেসের দ্বিতীয় বার্ষিক সভায়। আমার বলা উচিত যে, সে সময় যে কী হচ্ছিল, সে সম্বন্ধে আমার কোন ধারণা নেই। ব্রিটেনে আমরা আমেরিকার ইতিহাস পড়াই না। (হাসি) বরং চেপে রাখি। জানেন আপনারা, এটাই আমাদের পলিসি। (হাসি) কোন সন্দেহ নেই যে দারুণ কিছু একটা হচ্ছিল ১৮৬২-র ডিসেম্বরে, আমাদের মধ্যে আমেরিকান যাঁরা জানেন সে কথা। লিঙ্কন বলেছিলেনঃ "যে সব মতবাদ শান্ত অতীতের জন্য প্রযোজ্য, তা অস্থির বর্তমানের জন্য যথেষ্ট নয়। সময়টা সমস্যায় পাহাড়ে ভরে উঠেছে, আর আমাদের সেই সময়ের সাথে সাথে উঠে দাঁড়াতে হবে।" আমার দারুণ লেগেছে। সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নয়, সময়ের সাথে দাঁড়ানো । "যেহেতু আমাদের ক্ষেত্রটা নতুন, তাই আমাদের চিন্তা করতে হবে নতুনভাবে আর কাজ করতে হবে নতুনভাবে। আমাদের নিজেদের শৃঙ্খলমুক্ত করতে হবে আর তখনই আমরা দেশকে রক্ষা করতে পারব।" আমার ভাল লেগেছে "শৃঙ্খলমুক্ত" শব্দটা জানেন এর কি মানে? নানান ধ্যান-ধারনার কাছে আমরা দাসখত লিখে দিয়েছি, সেগুলো আমরা প্রশ্নাতীত বলে মেনে নিয়েছি যেন সেগুলোই প্রকৃতির বিধান, যেমনটি ঘটে থাকে। আর আমাদের বহু ধ্যান-ধারণাই তৈরি হয়েছে, এই শতাব্দীর পরিস্থিতিকে মোকাবেলার জন্য নয়, বরং বিগত শতকগুলির পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু আমাদের মন এখনো সেই সব ধ্যান ধারণায় সম্মোহিত। আর সেই ধ্যান ধারণার বেশ কিছু থেকে আমাদের নিজেদের শৃঙ্খলমুক্ত করতে হবে। এখন, এটা তো করার চেয়ে, বলা সোজা । এটা জানা খুব কঠিন, কী কী জিনিস আপনি ধরে নিয়ে বসে আছেন। কারণ আপনি তো সেগুলো ধরে নিয়েই বসে আছেন। তাহলে এমন কিছু আপনাদের জিজ্ঞেস করি যা আপনারা হয়তো ধরে নিয়ে বসে আছেন। এখানে আপনাদের মধ্যে কতজনের বয়স ২৫-এর ওপরে? এটা কিন্তু আপনাদের ধরে নেওয়া বলে আমি মনে করছি না। আমি নিশ্চিত এটা আপনারা ভাল করেই জানেন। ২৫-এর নীচে এখানে কেউ আছেন কি? বেশ। এখন, যাঁরা ২৫-এর ওপরে আপনারা কি আপনাদের হাতটা একটু ওপরে তুলবেন যদি হাতঘড়ি পরে থাকেন? বেশ অনেকেই তো আমাদের মধ্যে, তাই না? একঘর টিনএজারদের একই জিনিস জিজ্ঞেস করুন টিন এজাররা হাত ঘড়ি পরে না। আমি বলছি না যে ওরা পরতে পারে না, বা ওদের অনুমতি দেয়া হয় না, ওরা পরতে পছন্দই করে না। আর কারণটা হল, আপনি জানবেন, আমরা বড় হয়েছি প্রাক-ডিজিটাল সংস্কৃতিতে, আমাদের মধ্যে যারা ২৫-এর ওপরে তাঁরা। তাই আমাদের, যদি কটা বাজল জানতে চাওয়া হয়, কিছু পরতে হয় হাতে, সময় বলবার জন্য। ছোটরা এখন বাস করে এমন একটা পৃথিবীতে যেটা ডিজিটাইজড, আর সময়টা, ওদের কাছে, চারিদিকে। হাতে ঘড়ি পরার ওরা কোন কারণই খুঁজে পায় না। আর হ্যাঁ, অবশ্যই আপনাদেরও হাতে ঘড়ি পরার কোন প্রয়োজন নেই; সব সময় পরে এসেছেন, এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন এই যা। আমার মেয়ে কখনো ঘড়ি পরে না, আমার মেয়ে কেট, বয়স ২০। ও তো কোন কারণই খুঁজে পায় না। ওর ভাষায় "ঘড়ি তো মাত্র একটাই কাজ করতে পারে।“ (হাসি) "ভাবখানা যেন, ঘড়ি এতটাই ফালতু জিনিস !" আর আমি বলে উঠি, "না, না, ঘড়িতে তারিখও দেখা যায়।" (হাসি) "এটাও একাধিক কাজ করে।" কিন্তু দেখুন, শিক্ষাক্ষেত্রেও অনেক কিছুতে আমরা শৃঙ্খলিত। আপনাদের কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সেগুলোর মধ্যে একটা হল সরলরৈখিক এক ধারণা, এখানে শুরু হল, আপনি এক ট্র্যাক ধরে এগোলেন, যদি আপনি সব ঠিকঠাক করেন, আপনি সক্ষম হবেন বাকি জীবনটা গুছিয়ে নিতে। যারা TED-এ বক্তব্য রেখেছেন প্রত্যেকে আভাসে আমাদের জানিয়েছেন, বা কখনও সরাসরি, অন্য কোনো গল্পে, যে, জীবন সরলরৈখিক নয়, জীবন জৈবিক, বহুমাত্রিক। আমরা আমাদের জীবনটাকে গড়ে তুলি পারস্পরিক নির্ভরতার মধ্য দিয়ে একই সাথে আমরা আমাদের প্রতিভা খুঁজে নেই সেই সব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেগুলো আমাদের গড়তে সাহায্য করে। কিন্তু জানেন, আমাদের মাথায় ঢুকে বসে আছে এই সরলরৈখিক সূত্রটা। আর শিক্ষার শীর্ষশিখর সম্ভবতঃ কলেজে ঢোকা। আমার মনে হয় সবার মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে যে কলেজে পড়তেই হবে, যে কোনো ধরণের কলেজে। আমি বলছি না যে কলেজে যাওয়া উচিত নয়, কিন্তু সবার প্রয়োজন নেই যাওয়ার, আর সকলের এখনই যাওয়ার প্রয়োজন নেই। হয়তো পরে যাবে, এক্ষুনি নয়। কিছুদিন আগে আমি সান ফ্রান্সিস্কোয় গিয়েছিলাম বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে। এক ভদ্রলোক একটা বই কিনছে, বয়স ৩০-এর ঘরে। আমি বললাম, "কী কর?" ও বলল, "আমি দমকল বাহিনীতে কাজ করি।" আমি বললাম, "কত দিন ধরে তুমি দমকল বাহিনীতে কাজ কর?" ও বলল, "সব সময়, আমি সব সময় দমকল বাহিনীতে কাজ করি।" আর আমি বললাম, "তা, কবে ঠিক করলে?" “ছোটবেলাতেই", সে বলল, "আসলে, আমার ক্ষেত্রে সমস্যাটা স্কুল থেকেই, কারণ স্কুলে, সবাই দমকল বাহিনীতে কাজ করতে চাইত।" "আর আমি সত্যিই দমকল বাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিলাম।" আরো বলল "যখন উঁচু ক্লাসে উঠলাম, আমার শিক্ষকরা ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিল না। একজন শিক্ষক যিনি ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেননি, তিনি বললেন আমি জীবনটাকে নষ্ঠ করছি, যদি আমি সত্যিই দমকল বাহিনীতে যোগ দিতে চাই, বলেছিলেন আমার কলেজ-এ যাওয়া উচিত, পেশাদার হওয়া উচিত, বলেছিলেন আমার মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা, আর আমি আমার প্রতিভা নষ্ট করছি।" সে বলে গেলো, "খুবই অপমানকর, কারণ উনি গোটা ক্লাসের সামনে কথাগুলো বলেছিলেন,আমার ভীষণই খারাপ লেগেছিল। কিন্তু আমি এটাই চেয়েছিলাম, আর যেই স্কুল ছাড়লাম, দমকল বাহিনীতে আবেদন করলাম আর সুযোগও পেয়ে গেলাম।" ও বলে গেল, "জানেন, কিছুক্ষণ আগেই সেই মানুষটির কথা ভাবছিলাম, কয়েক মিনিট আগে যখন আপনি বক্তব্য রাখছিলেন, ওই সেই শিক্ষকের কথা," ও বলল, " কারণ ছয় মাস আগে আমি ওঁকে প্রাণে বাঁচিয়েছি।" (হাসি) সে বলল, "চূর্ণ-বিচূর্ণ এক গাড়ির মধ্যে ছিলেন উনি, আমি তাকে টেনে বের করে আনি, সিপিআর দিই, আর ওঁনার স্ত্রীকেও বাঁচাই।" ও তারপর বলল, "মনে হয় আমার সম্পর্কে আগের থেকে এখন ওঁর ধারণা ভাল হয়েছে।" (হাসি) (হাততালি) জানেন, আমি মনে করি, জনসমাজ নির্ভর করে নানান ধরণের প্রতিভার ওপর, কোন এক মাত্র দক্ষতার ওপর নয়। আর আমাদের সমস্ত চ্যালেঞ্জের কেন্দ্রে -- (হাততালি) সমস্ত চ্যালেঞ্জের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষের দক্ষতা সম্বন্ধে আমাদের ধারণাকে নতুন করে রূপ দেওয়া এবং মানুষের বুদ্ধি সম্বন্ধে। সরলরৈখিক ব্যাপারটা একটা সংকট। যখন আমি এল.এ তে এলাম প্রায় ন বছর আগে, একটা নীতির বর্ণনা দেখেছিলাম, উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ভাল ছিল, যেটায় বলা ছিল,"কলেজের শুরু কিন্ডারগার্টেনে।" না, কখনই না। (হাসি) একেবারেই নয়। সময় থাকলে, এ বিষয়ে বিস্তারিত যেতে পারতাম, কিন্তু নেই। (হাসি) কিন্ডারগার্টেনের শুরু কিন্ডারগার্টেনে। (হাসি) আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল, "জানো, তিন বছর বয়সের শিশু ছ বছরের শিশুর অর্ধেক নয়।" (হাসি) (হাততালি) ওরা তিন বছরেরই। কিন্তু একটু আগেই আমরা যে শুনলাম, কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হওয়ার যা প্রতিযোগিতা আজকাল, ঠিক কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হওয়ার, শিশুরা তো এখন তিন বছর বয়সেই ইন্টারভিউয়ের সামনে। বাচ্চারা বসে আছে একদল ভাবলেশহীন বিশেষজ্ঞের সামনে, ওদের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে, (হাসি) পাতা ওল্টাচ্ছেন আর বলছেন, "ব্যাস্ এইটুকুই?" (হাসি) (হাততালি) "৩৬ মাস কাটিয়ে দিলে, আর এটুকুই?" (হাসি) "কিছুই তো করে উঠতে পারো নি, বল। প্রথম ছ মাস তো মায়ের দুধ খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছ, যা দেখতে পাচ্ছি।" (হাসি) দেখছেন, কেমন ভয়ংকর ব্যাপার, কিন্তু এগুলোই মানুষকে আকর্ষণ করে। আরেকটা বড় ব্যাপার হচ্ছে ছাঁচে গড়ে তোলা। আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তুলেছি ফাস্ট ফুডের মডেলে। এই সম্পর্কে জেমি অলিভার বলছিলেন সেদিন। আপনারা জানেন তো যে কেটারিং-এ গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য দু-রকমের মডেল আছে। একটা হল ফাস্ট ফুড, যেখানে সব কিছু একটাই নির্দিষ্ট মানের। আর এক ধরণ হল জ্যাগাট আর মিশেলিন রেঁস্তোরার মত, যেখানে সবকিছু একটাই নির্দিষ্ট মানের নয়, বিশেষ অবস্থায় বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। আর আমরা ফাস্ট ফুড মডেলের শিক্ষা ব্যবস্থার কাছে নিজেদেরকে বিক্রি করে দিয়েছি। আর সেটা আমাদের মনোবল, আমাদের শক্তিকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে যেভাবে ফাস্ট ফুড নিঃশেষিত করছে আমাদের দেহকে। (হাততালি) আমার মনে হয় আমাদের কয়েকটা জিনিস এই প্রসঙ্গে বুঝে নিতে হবে। এক হল মানুষের প্রতিভা ভীষণ রকমের বৈচিত্র্যে ভরা। মানুষের প্রবণতাগুলোও নানান ধরণের। খুব সম্প্রতি আমি টের পেয়েছি যে ছোটবেলায় আমাকে একটা গীটার দেওয়া হয়েছিল মোটামুটি একই সময়ে যখন এরিক ক্ল্যাপটন ওর প্রথম গীটারটা পায় আপনারা জানেন, এরিকের জন্যে গীটারটা কাজে দিয়েছিলো, ব্যাস এটুকুই শুধু বলছি। (হাসি) অন্য দিকে, আমার জন্যে দেয়নি। আমি ওটাকে দিয়ে কাজ করাতে পারিনি যত ঘন ঘন, বা যত জোরেই ওটা বাজাবার চেষ্টা করি না কেন। ওটা কাজ করতই না। কিন্তু ব্যাপারটা শুধু এটুকুই নয়। ব্যাপারটা উদ্দীপনার। অনেক সময়ই লোকে যে জিনিস খুব ভাল পারে সেগুলোকে পাত্তাই দেয় না। ব্যাপারটা আন্তরিক উদ্দীপনার, কোন্ জিনিসটা আমাদের আত্মিক শক্তিকে জাগায়। আর যেটা আপনি করছেন সেটাই যদি আপনি করতে ভালবাসেন, ভাল পারেন, সময়ের গতিই পুরো বদলে যায়। আমার স্ত্রী এর মধ্যেই একটা উপন্যাস লেখা শেষ করে ফেললেন, আমার মনে হয় দারুণ একখানা বই, কিন্তু টানা বহুক্ষণ ধরে ওঁকে দেখতে পাওয়া যেত না। আপনি জানেন, যদি আপনি যেটা আপনি ভালবাসেন সেটাই করেন , এক ঘন্টাকে পাঁচ মিনিট বলে বোধ হয়। যদি আপনি যা করছেন তা আপনার মনের সুরে না বাজে, পাঁচ মিনিটকে মনে হয় এক ঘন্টা। বহু মানুষ যে পড়াশোনা ছেড়ে চলে যাচ্ছে তার কারণ হল সেই শিক্ষা ওঁদের মনের রসদ জোগাতে পারছে না, সেই শিক্ষা ওঁদের শক্তি, ওঁদের আগ্রহের যথেষ্ট খোরাক নয়। সুতরাং আমি মনে করি আমাদের উপমাগুলো পাল্টাতে হবে। আমাদের সরে আসতে হব কারখানার মডেলে তৈরি শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে, পণ্য উৎপাদনকারী কারখানার মডেল থেকে, যা নির্ভর করে আছে সরল রৈখিক পদ্ধতির ওপর ছাঁচে গড়ে তোলা আর মানুষদের দলে দলে ভাগ করার ওপর আমাদের যেতে হবে এমন একটা মডেলে যেটা অনেকটা কৃষিকাজের নীতির মত করে তৈরী। আমাদের বুঝে নেওয়া দরকার মানুষের বৃদ্ধি একটা যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়, এটা একটা জৈবিক প্রক্রিয়া। আর মানুষের উন্নতির পরিণতির ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না; আপনি শুধু, একজন কৃষকের মত অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারেন যার মাধ্যমে মানুষ বেড়ে উঠতে পারে। তাই যখন আমরা শিক্ষার সংস্কার করতে চাই বা পরিবর্তন করতে চাই, সেটা কিন্তু একটা ব্যবস্থার ক্লোন তৈরি করার মত নয়। তা অনেক ব্যবস্থাই আছে, কেআইপিপি-র মত, এটা বেশ ভাল ব্যবস্থা। অনেক দারুণ দারুণ মডেল আছে। ব্যাপারটা হল অবস্থার প্রেক্ষিতে এটাকে ছাত্রের জন্য তৈরি করে নেওয়া, এবং শিক্ষাকে ব্যক্তিগত করা সেই ব্যক্তির উপযোগী করে, আসলে যাকে আপনি শেখাচ্ছেন। আর সেটা করাটাই, আমি মনে করি আগামীদিনের চাবিকাঠি কারণ ব্যাপারটা তো আর একটা নতুন পন্থাকে দাঁড়ি-পাল্লায় মাপজোখ করা নয়; ব্যাপারটা শিক্ষাক্ষেত্রে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করার যেখানে মানুষ নিজেই নিজের পন্থা আবিষ্কার করে নেবে, অবশ্যই সঙ্গে থাকবে বাইরের সাহায্য যার ভিত্তি হবে একটা ব্যক্তিগত পাঠক্রম। এখন, এই ঘরে, অনেকে আছেন যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করছেন অনন্য সাধারণ সব সম্পদের -- ব্যবসায়, মাল্টিমিডিয়ায়, ইন্টারনেটে। এসব প্রযুক্তি শিক্ষকদের অসাধারণ প্রতিভার সঙ্গে মিলিয়ে শিক্ষায় বিপ্লব ঘটানোর সুযোগ এনে দিচ্ছে। আমি অনুরোধ করব আপনাদের এতে সামিল হতে কারণ এটা গুরুত্বপূর্ণ, শুধু আমাদের জন্য নয়, বরং আমাদের শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু আমাদের পণ্য তৈরীর কারখানার মডেল পাল্টে চাষাবাদের মডেলে আসতে হবে, যেখানে প্রত্যেকটা স্কুল সাফল্য পেতে পারে। যেখানে শিশুরা জীবনকে প্রত্যক্ষ করতে পারে। কিংবা বাড়িতে, যদি তারা বাড়িতেই পড়াশোনা করতে মনস্থ করে পরিবারের সঙ্গে বা বন্ধুদের সঙ্গে। স্বপ্ন নিয়ে বেশ কিছু কথা হয়েছে গত কয়েকদিনে। আর আমি চাইছি খুব কম সময়ে -- কাল রাত্রে নাতালি মারচাণ্ট-এর গানে আমি ভীষন আপ্লুত পুরোন দিনের কবিতা ফিরিয়ে দেওয়া গান। আমি আপনাদের খুব কম সময়ে একটা ছোট কবিতা পড়ে শোনাতে চাইছি ডাব্লু, বি, ইয়েটসের, যাঁকে হয়তো আপনারা জানেন। ওঁর প্রেমিকাকে লেখা, মড গন, কবি দুঃখ করছেন যে প্রেমিকা ওঁর কাছ থেকে, যা চেয়েছিলেন বলে ওঁর মনে হয়, তিনি তা দিতে পারেন নি তাই বলছেন, "আমার কাছে আছে অন্য কিছু, যা নাও হতে পারে তোমার মনের মত।" ইয়েটস বলছেনঃ থাকত যদি বসনখানি অমরাবতী আঁকা, সোনার জলে আঁকা আর রূপোলী আলোয়, নীলাভ আর আবছা আর ঘনবর্ণ বসন রাত্রির আর আলোর আর আলো-আঁধারির, বিছিয়ে দিতেম বসনখানি তোমার চরণতলে; কিন্তু আমি নিঃস্ব বলে, কেবল আছে স্বপ্ন মোর; বিছিয়ে দিলেম তোমার চরণ তলে; সাবধানে চরণ ফেলো কারণ তুমি চরণ ফেলছ আমার স্বপ্নে।" প্রতিদিন, আনাচে কানাচে আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের স্বপ্ন ছড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের পায়ের তলে। আমাদের পা ফেলতে হবে সাবধানে। ধন্যবাদ। (হাততালি) অনেক ধন্যবাদ।