আমার তখন ১০ বছর বয়স বাবার সঙ্গে তাঁবুতে অবকাশযাপন করতে গেছিলাম অ্যাডিরোন্ড্যাক পর্বতে, ওটা একটা অরণ্য অঞ্চল যেটা নিউ ইয়র্ক রাজ্যের উত্তর অংশে অবস্থিত। দিনটা খুব সুন্দর ছিল। জঙ্গলটা আলো ঝলমলে ছিল। রোদ পড়ে গাছের পাতা গুলো রঙিন কাচের মত ঝক ঝক করছিল, আর আমরা যে পথটা অনুসরণ করছিলাম সেটা যদি না থাকতো তাহলে আমাদের প্রায় এমন লাগতো যেমন ওই মাটিতে আমরাই প্রথম মানুষ যারা পা ফেলেছি। আমরা আমাদের ক্যাম্পস্থলে উপস্থিত হলাম। ওটা খাড়া পাহাড়ের গায়ে লাগানো একটা চালা যার নীচে একটা অপূর্ব, স্ফটিক স্বচ্ছ ঝিলের শোভা দেখা যায়, আর তখনই আমি একটা জঘন্য ব্যাপার আবিষ্কার করলাম। ওই হেলান চালার পিছনে একটা আস্তাকুড়, প্রায় ৪০ বর্গ ফুটের যেটা পচা আপেলের শাঁস আর দুমড়ানো অ্যালুমিনিয়াম তবক আর পরিত্যক্ত জুতো দিয়ে ভরা ছিল। আর আমার অবাক লেগেছিল, আমি খুব রেগে গেছিলাম, আর আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেছিলাম। যে সব শিবিরবাসী এত অলস যে তারা যেটা নিয়ে আসে সেটাও নিয়েও যায় না, তারা কি চিন্তা করে যে তাদের আবর্জনা কে পরিষ্কার করবে? এই প্রশ্নটা আমার মনে থেকে গিয়েছিল, আর প্রশ্নটা একটু সরল হয়েছিল। আমাদের আবর্জনা কে পরিষ্কার করে? সেটা আপনি যেভাবেই ভাবুন বা এই আমাদের যেখানেই স্থাপন করুন, আমাদের আবর্জনা ইস্তাম্বুলে কে পরিষ্কার করে? রিও তে আমাদের আবর্জনা কে সরায় বা প্যারিস কিংবা লন্ডনে? এই এখানে নিউ ইয়র্কে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিভাগ আমাদের আবর্জনা পরিষ্কার করে, যার পরিমাণ হল ১১,০০০ টন আবর্জনা আর ২,০০০ টন রিসাইকেল যোগ্য বর্জ্য। আমি এই মানুষগুলোকে ব্যক্তিগত ভাবে জানতে চেয়েছিলাম। আমি বুঝতে চাইছিলাম যে এই কাজটা কারা করতে চায়। ওই উর্দিটা পড়তে আর এই দায়িত্বের বোঝা বইতে কেমন লাগে? তাই আমি ওনাদের সঙ্গে নিয়ে একটা গবেষণামূলক কার্যক্রম শুরু করলাম। আমি ওই ট্রাকে চড়ে ঘুরলাম আর ওই রাস্তায় হাঁটলাম আর পুরো শহরে লোকের সাক্ষাৎকার নিলাম বিভিন্ন অফিস আর দপ্তরে, আর আমি অনেক কিছু জানতে পারলাম, কিন্তু তবু আমি ছিলাম একজন বাইরের লোক। আমার আরও ভেতরে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। আর তাই আমি একজন জঞ্জাল কর্মীর কাজ নিলাম। এখন আমি শুধু ট্রাকে চড়ছিলাম না। আমি ট্রাক চালাচ্ছিলাম। আর আমি যান্ত্রিক ঝাঁটা চালাতাম আর বরফ সাফাই করতাম। ওটা একটা অসাধারণ মর্যাদার আর চমকপ্রদ ভাবে শিক্ষণীয় কাজ ছিল। সবাই গন্ধের কথা জিগ্যেস করে। ওটা ছিল কিন্তু ওটা আপনারা যতটা ভাবেন ততটা ব্যাপক ছিল না, আর যে সব দিনে ওটা খুব বেশী থাকে, আপনি খুব তাড়াতাড়ি ওটাতে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। ওজনটাতে অভ্যস্ত হতে অনেক সময় লাগে। আমি এমন লোকদের জানতাম যারা এই কাজে বহু বছর আছে তবু তাদের শরীর তখনও টন কে টন জঞ্জালের গুরুভার প্রতি সপ্তাহে শরীরের ওপর বহন করতে অভ্যস্ত হচ্ছে। আর আছে বিপদের ভয়। শ্রমিক পরিসংখ্যান ব্যুরো অনুযায়ী জঞ্জাল সাফাই দেশের ১০ টা সবথেকে বিপদজনক কাজের একটা, আর আমি জানতে পেরেছিলাম কেন। আপনি সারাদিন যানবাহনের স্রোতে ঢোকা বেরুনো করেন, আর ওগুলো আপনার চারধারে সাঁই সাঁই করে চলে। এরা শুধু আপনাকে ছাড়িয়ে আগে যেতে চায়, তাই প্রায়ই গাড়ির চালক মনোযোগ দেয় না। সেটা কর্মীদের জন্য খুবই খারাপ। আর তাছাড়া জঞ্জালে এমনিতেই বিভিন্ন ঝুঁকি থাকে আর প্রায়ই সেগুলো ট্রাকের পিছন থেকে ছিটকে পড়ে আর ভয়ানক ক্ষতি ঘটায়। আমি জঞ্জালের নিরবচ্ছিন্নতা সম্পর্কেও জানতে পারলাম। আপনি যখন ফুটপাথ থেকে নেমে আসেন আর একটা শহরকে একটা ট্রাকের পিছন থেকে দেখেন, আপনি বুঝতে পারেন যে জঞ্জাল নিজে একটা প্রাকৃতিক শক্তির মত। এটার আসা কখনো বন্ধ হয় না। এটা শ্বাসপ্রশ্বাস বা রক্তসঞ্চালনের মত। এটাকে অবিরত সচল থাকতে হবে। আর আছে এর সঙ্গে জড়িত কলঙ্ক। আপনি উর্দিটা পরার সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যান যতক্ষণ না কেউ কোন কারণে আপনার ওপর অসন্তুষ্ট হয় যেমন যখন আপনি আপনার ট্রাক দিয়ে গাড়ি চলার রাস্তা আটকে দেন বা আপনি কারো বাড়ির খুব কাছে বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নেন, বা আপনি একই রেস্তোরাঁয় কফি খেতে যান, আর তখন ওরা এসে আপনাকে ঘৃণার চোখে দেখবে, আর আপনাকে জানিয়ে দেবেন যে ওরা আপনাকে ওনাদের ত্রিসীমানায় দেখা পছন্দ করেন না। আমার এই কলঙ্কের ব্যাপারটা খুব উদ্ভট মনে হয়, কারণ আমি বিশ্বাস করি যে জঞ্জাল সাফাই কর্মীরা আমাদের শহরের রাস্তার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শ্রমশক্তি আর এর তিনটে কারণ। ওরা জনস্বাস্থ্যের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক। ওনারা যদি প্রতিদিন জঞ্জাল না সরান দক্ষতা আর সক্রিয়তার সঙ্গে, ওগুলো ওদের আধার থেকে উপচে পড়বে আর তার ফলে যে বিপদের সৃষ্টি হয় সেটা আমাদের অস্তিত্বকে বাস্তবিক ভাবে বিপন্ন করে। যে সব রোগভোগ কয়েক দশক বা শতক ধরে নিয়ন্ত্রণে আছে সেগুলোর আবার প্রাদুর্ভাব ঘটবে আর আমাদের সর্বনাশ ঘটাবে। অর্থনৈতিক কারণেও ওদের প্রয়োজন আছে। আমরা যদি পুরনো জিনিষ ফেলে দিতে না পারি, নতুন জিনিষ রাখার জায়গা থাকবে না, আর তখন অর্থনীতির চাকা ব্যয়ের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে থেমে থেমে ঘুরবে। আমি পুঁজিবাদের স্বপক্ষে বলছি না, আমি শুধু ওদের পরস্পরের সম্পর্কটা তুলে ধরছি। আর যেটা আছে সেটাকে আমি বলি আমাদের গড়পড়তা প্রয়োজনীয় প্রাত্যহিক গতি। এটা দিয়ে আমি শুধু বোঝাতে চাই আমরা আজকের দিনে আর যুগে কত দ্রুত চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমরা সাধারণত কফির কাপ, বাজারের ব্যাগ বা জলের বোতল সারাই করা, পরিষ্কার করা বা সঙ্গে করে ঘোরা নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমরা ওগুলো ব্যবহার করি, ছুঁড়ে ফেলে দিই আর ওগুলোকে ভুলে যাই, কারণ আমরা জানি যে অন্য দিকে একটা শ্রমশক্তি আছে যেটা এই সব কিছু সরিয়ে নিয়ে যাবে। তাই আজ আমি জঞ্জাল সাফাই সম্পর্কে চিন্তা করার এমন দুটো রাস্তা বাতলাতে চাই যেটা হয়ত ওটার কলঙ্ক মোচন করতে পারবে আর ওনাদের টেনে আনতে পারবে একটা মানবিক আর দীর্ঘজীবী শহর কিভাবে গড়ে তোলা যায় সেই আলোচনায়। আমার মনে হয়, ওনাদের কাজ খানিকটা গণ প্রার্থনার মত। ওনারা প্রতিদিন একটা নিয়মিত ছন্দে রাস্তায় কাজ করে যান। ওনারা অনেক শহরে উর্দি পড়ে থাকেন। আপনি জানেন যে ওনারা ঠিক কখন আসবেন। আর ওনাদের কাজের জন্যই আমরা আমাদের কাজ করতে পারি। ওনারা যেন এক ধরণের ভরসা। ওনারা যে প্রবাহ বজায় রাখেন সেটা আমাদের নিজেদের থেকে সুরক্ষিত রাখে, আমাদের নিজেদের আবর্জনা আর পরিত্যক্ত জিনিষপত্র থেকে, আর এই প্রবাহ সব সময় বজায় রাখা জরুরি যাই ঘটে যাক না কেন। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের পরের দিন আমি রাস্তায় একটা জঞ্জালের ট্রাকের গরগর শব্দ শুনতে পেলাম, আর আমি আমার নবজাত ছেলেকে তুলে নিয়ে নীচের তলায় দৌড়ে গেলাম আর দেখলাম একজন লোক তার কাগজ রিসাইকেলের নির্দিষ্ট পথে কাজ করে যাচ্ছেন যেমন তিনি করেন প্রতি বুধবার। আর আমি ওনাকে ওনার কাজ করার জন্য ধন্যবাদ দেওয়ার চেষ্টা করলাম সব দিনের মধ্যে সেই দিনটাতেই কিন্তু আমি কাঁদতে লাগলাম। আর উনি আমার দিকে দেখলেন, আর শুধু মাথা নাড়লেন, আর উনি বললেন, "আমরা ঠিক থাকবো। আমরা ঠিক থাকবো।" এর কিছু পরেই আমি জঞ্জাল সাফাই নিয়ে আমার গবেষণা শুরু করি, আর আমার সঙ্গে সেই লোকটার আবার দেখা হয়। ওনার নাম পলি, আর আমরা অনেক বার একসঙ্গে কাজ করেছি, আর আমরা ভালো বন্ধু হয়ে গেছিলাম। আমি বিশ্বাস করতে চাই যে পলি ঠিক বলেছিল। আমরা ঠিক থাকবো। কিন্তু আমরা একটা প্রজাতি হিসেবে কিভাবে এই গ্রহে টিকে থাকবো সেটাকে পুনর্বিন্যাস করার আমাদের এই প্রচেষ্টায় আমাদের অবশ্যই অন্তর্গত করতে হবে আর বিবেচনা করতে হবে সব রকম মূল্যের, শ্রমের যে মানবিক মূল্য আছে তারও। আর আমাদের ভালো ভাবে জানতে হবে যারা সেই কাজ করে তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করে, তাদের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা কিভাবে ধারণা করবো, আমরা কি ভাবে গঠন করবো এমন একটা দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা যেটা হয়ত আমাদের ফুটপাথের পাশে করা রিসাইকেলের কাজ যেটা কিনা ৪০ বছরের একটা অসামান্য সাফল্য, তার থেকে পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশে পৌঁছে দেবে, আর আমাদের জন্য একটা আরও প্রশস্ত দিগন্ত উন্মোচিত করবে যেখানে আমরা অন্যান্য রকমের জঞ্জাল কম করার সম্পর্কে ভাবতে পারবো যে জঞ্জালের উৎস উৎপাদন ও শিল্প। আমরা যখন জঞ্জাল নিয়ে কথা বলি আমরা ভাবি পৌর জঞ্জালের কথা যেটা দেশের জঞ্জাল প্রবাহের তিন শতাংশ। এটা একটা চমকপ্রদ পরিসংখ্যান। তাই আপনার দিনপ্রবাহে আপনার জীবন প্রবাহে পরের বার যখন কাউকে দেখবেন যার কাজ আপনার জঞ্জাল পরিষ্কার করা, একটু সময় করে ওনাদের স্বীকৃতি দেবেন। একটু সময় করে ধন্যবাদ জানাবেন। (হাততালি)