আপনার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জায়গা কোনটি? এবং যখন আপনি সেখানে ছিলেন, আপনি কি ছবি তুলেছিলেন? এটা আমার দেখা সবচেয়ে সবচেয়ে সুন্দর জায়গার একটি। এটা হচ্ছে মেসা আর্চ, ক্যানিওনল্যান্ডস ন্যাশনাল পার্ক, ইউটাহ সুর্যোদয়ের সময়। জায়গাটা পুয়েবলো, ইউট, পাইউট আর নাভাহোদের ঐতিহ্যবাহী স্বদেশ, আর আপনি যখন সেখানে থাকবেন, এটি সত্যিই অত্যাশ্চর্য। সূর্যোদয়ে খিলানের নীচকে কমলা রঙে রাঙিয়ে দেয়, এবং এর পিছনে থাকে খাড়া পাহাড়, মেঘ আর খাড়া বাঁধ। কিন্তু আপনি আমার এই ছবি থেকে যেটা দেখবেন না সেটা হলো আরো ৩০ জন মানুষও আমার পিছনে ছবি তুলছিলেন। আর এরাইতো সেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সুর্যোদয়ের মানুষ, তাইনা? তো আপনি যদি চিন্তা করেন, মেসা আর্চের হাজার না হলেও প্রতি সপ্তাহে শখানেক ছবিতো তোলাই হয়। আমি অনেকবছর ধরে আমার আলোকচিত্রবিদ্যা ইনস্টাগ্রামে ভাগ করে যাচ্ছি, আর এটা খুবই মজাদার এমনকি হাসিরও হয়ে উঠছিলো, যে একই জায়গার একই ধরণের কত ছবি অনলাইনে দেখা শুরু করেছিলাম। আর আমি এর অংশীদারও ছিলাম। এটা আমাকে ভাবাতে শুরু করলো আমরা ছবি তুলিই বা কেন? কখনো কখনো আমি বিখ্যাত কোন জায়গায় যাই, যেমন এটি আরিজোনার হর্সশু বেন্ড -- এবং আমি দেখি প্রচুর মানুষের হাতে ফোন আর ক্যামেরা যারা ছবি তোলে শুধু ফিরে গিয়ে গাড়িতে ওঠার জন্য বা আবার নিজপথে চলতে শুরু করার জন্য। এবং কখনও এমনও মনে হয় আমরা একটা জায়গাকে নিজের জন্য অনুভব করার বা নিজের চোখে দেখার আসল উদ্দেশ্যটাই হাতছাড়া করে দিচ্ছি। যখন আমি ক্যামেরার পিছনে থাকি, আমি সূক্ষাতিসূক্ষ জিনিসগুলোও খেয়াল করিঃ পাহাড়ের গায়ে আলোর স্তর যখন দিনের শেষে আলো কমে আসে; অথবা প্রকৃতির অভিজ্ঞ হাতে বানানো আকার যা বিমূর্ত কিন্তু নির্ভুল। আমি প্রকৃতির এসব জটিল আবিষ্কার আর সেগুলো নিয়ে আমার উপলব্ধি সম্পর্কে টানা বলে যেতে পারি। পৃথিবীর এই সৌন্দর্য আর অদ্ভূত জটিলতার ছবি তোলা আমার কাছে ভালোবাসার কারো ছবি তৈরি করার মত। আর আমি যখন ছবি তৈরি করি, আমাকে ভাবতে হয় আমি কি বলতে চাই। আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি আমি এটা দ্বারা কি অনুভব করাতে চাই। আপনি যখন একটি ছবির মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করেন, প্রত্যেকটি সৃজনী বাছাইয়ের আলাদা গুরুত্ব আছে। আমি কখনো ভাগ করে নেয়ার জন্য ছবি তুলি, অন্যসময় শুধু নিজের জন্য তুলি। আমি বর্তমানে বাইরের দুনিয়ার ভবিষ্যত নিয়ে একটি ভিডিও ক্রম উপস্থাপনা করছি, এর একটি পর্বের জন্য আমরা চাচ্ছিলাম বুঝতে আলোকচিত্রবিদ্যা্র সাথে বাইরের পৃথিবীর সম্পর্ককে। আমি জানতে পারলাম ইউএসসিতে ক্রিস্টিন ডিল এবং তার সহকর্মীদের সম্পর্কে, যারা ছবি তোলার সাথে আনন্দের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন। তারা পেয়েছেন যে যখন আমরা ক্যামেরার পেছনে থাকি, এবং যখন আমরা ছবি তুলি, আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাকে আরো বেশি উপভোগ করি, কম না। কিন্তু সেটা সবসময় সত্যি না। যিনি ছবি তুলেছেন তিনি যদি শুধুমাত্র মানুষকে দেখানোর জন্য ছবিটি তোলেন তাহলে আনন্দ বাড়েনা, কারণ তিনি এটা নিজের জন্য করেননি। অতএব এটি একটি গুরুত্বপূর্ন পার্থক্য দেখায়ঃ আলোকচিত্রবিদ্যা আপনার উপভোগকে বাড়াতে পারে যদি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়। নিজের ইচ্ছাটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। একজন আলোকচিত্রী হিসেবে আমাকে এটা নিয়ে খুবই ভাবতে হয়। কখন আমি চাই আমার ক্যামেরা বের করতে, এবং কখন চাই এটি সরিয়ে রাখতে? আলাস্কায় যাত্রার সময় আমার সুযোগ এসেছিলো আলাস্কার খয়েরী ভালুকের ছবি তোলার। আমি তখন নৌকায় আরো চার আলোকচিত্রীর সাথে ছিলাম, এবং আমরা সবাই ই একই সময়ে ঐ প্রানীগুলোর এত কাছে থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মত ছিলাম। এটি আবেগপ্রবণ একটি অভিজ্ঞতা। ভালুকগুলোর চোখের সামনে থেকে আমার এমন একটি যোগাযোগের অনুভূতি হয়, যেটা শব্দভান্ডারকে ছাড়িয়ে যায়, এবং সাথে ক্যামের থাকায় অনুভূতিটা আরো বেড়ে যায়। আমরা সবাই ই স্বাধীনভাবে ছবি তুলছিলাম, কিন্তু একইসাথে ঐ মূহুর্তেও ছিলাম, প্রকৃতির সাথেও এবং একে অন্যের সাথেও। আমার পরিষ্কার মনে আছে পানির ফোঁটাগুলোর ক্যামেরাবন্দী করার সময়টা যখন ভালুকগুলো সাঁতরে যাচ্ছিলো এবং ভালুকছানারা মায়েদের অনুসরণ করছিলো। সেই আলোকচিত্রীর দল আর আমি এই অনুভূতিটা বারবার পাবো, যতবার আমরা পেছন ফিরে ছবিগুলো দেখবো, সময় থেকে সময়ে, এবং আলোকচিত্রবিদ্যাই আমাদের সেই সুযোগটা করে দিয়েছে। অন্য সময়, আমি আমার ক্যামের ফেলে রাখি, এবং বুঝতে পারি ফেলে রাখার সিদ্ধান্তটাই আমার অভিজ্ঞতা এবং আমার কাজের জন্য ভালো। কিছুদিন আগে আমি উড়াল দিয়েছিলাম টঙ্গার সাউথ প্যাসিফিক আইল্যান্ডে হাম্পব্যাক তিমিদের সাথে সাঁতার কাটার জন্য। আমি খেয়াল করলার নিজের মধ্যে চাপ আর একধরনের দায়িত্ববোধ আমার ক্যামেরা নেয়ার জন্য, যখন আমি শুধু নিজের জন্যই অভিজ্ঞতাটা নিতে চাই। এবং সেই অভিজ্ঞতাটা সত্যিই আশ্চর্যজনক। আমি কথা বলছি পানিতে একটি কৌতুহলী শিশু প্রাণীর সাথে থাকা যার আকার একটি গাড়ির সমান যখন আপনার চারপাশের জিনিস আলোকরশ্মির মত ভাসছে আর প্রানীটির মা অত্যন্ত শৃঙ্খলার সাথে আপনার নীচে সাঁতার কাটছে। অবশ্য কিছু সময় ছিলো যখন আমি আমার ক্যামেরা সাথে নিয়েছিলাম, এবং সেই সময়গুলো অসাধারণ ছিলো ক্যামেরাবন্দী করার জন্য। কিন্ত ক্যামেরাটা ছিলো অনেক বড়। একটা বাক্সের মত। এরকম দেখতে। এবং এটি হচ্ছে আমি আর আমার তিমিদের মধ্যে, এবং অনেকসময় মনে এটি আপনি আর বাস্তবতার মাঝে একটা বাঁধের মত। যদি এটা ফোনে হয় তাহলে কি কোন পার্থক্য আছে? আগের বছর আমি কেন্দ্রীয় অস্ট্রেলিয়ার উলুরুতে গিয়েছিলাম, যেটা হচ্ছে এই বিশাল পাথরটা যেটা মরুভূমির উপর ঢেকে থাকে। এর মাটি আনাঙ্গুদের কাছে পবিত্র যারা এই জায়গার আদিবাসী এবং এই জায়গার ঐতিহ্যগত অধিকারী। উলুরুর এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে আপনাকে পেশাগত কারণে ছবি তুলতে দেবেনা, কারণ সেগুলো তাদের সংস্কৃতির প্রতি সংবেদনশীল, জায়গাগুলো আনাঙ্গুদের কাছে পবিত্র শাস্ত্রের সমান। এই কারণে আমার সেখানের অধিকাংশ ছবি অনেক দূর থেকে তোলা, যেমন এটি, অথবা নির্দিষ্ট কোন জায়গা থেকে তোলা। আপনি বলতে পারেন উলুরুর সবচেয়ে আকর্ষনীয় এবং সুন্দর জায়গাগুলো এই সংবেদনশীল অংশগুলোর ভিতরে, কিন্তু ছবি না তোলার অনুরোধ একধরণের স্পষ্ট ও সরাসরি আমন্ত্রণ এই জায়গা, তাদের গুরুত্ব এবং এর মানুষ সম্পর্কে জানার। এবং সেটাই কি আমাদের করা উচিত না? তো আমার উলুরু যাত্রা খুব তাড়াতাড়ি আমাকে নিয়ে না বরং এই জায়গার সাথে যোগাযোগ স্থাপন নিয়ে পরিণত হয়। হাস্যকর এবং অনুমেয়ভাবে আমি বুঝতে পারি যে উপস্থিত থাকা এবং যোগাযোগ স্থাপন করা একইসাথে আরো উদ্দীপক ছবি তৈরি করতে পারে। আমরা সবাই ই খুব সম্ভবত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিজের ভ্রমণের এবং জীবনের ছবি ভাগ করে নেয়ার ভালো জায়গা বলবো। আমরা শুধু আমাদের দেখা পৃথিবীর অংশকেই ভাগ করে নেইনা, একইসাথে আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাও ভাগ করি। এবং যদি ছবিগুলো তোলায় আমাদের ইচ্ছার প্রভাব থাকে, তবে আশা করি ভাগ করে নেয়ার মাঝেও ইচ্ছার প্রভাব আছে। আমার জন্য নিজের গল্প এবং আমার দৃষ্টিকোনকে অনলাইনে ভাগ নেয়ার অভিজ্ঞতা আমাকে মনে করিয়েছে যে আমি একা না। এটা আমাকে সহায়তা করেছে সমর্থন ও একটি সম্প্রদায় তৈরি করতে যারা অন্যদের জন্যও একই কাজ করে। একটা জায়গায় পরিস্কার হইঃ আমি আপনাকে ছবি তোলায় অনুৎসাহিত করতে চাচ্ছিনা। এমনকি যদি হাজারখানেক মানুষও একই জায়গায় গিয়ে একই ছবি তোলে, তাও আমি আপনাকে বলবো সেখানে গিয়ে ছবি তুলতে। পৃথিবীর প্রত্যেকটি কন্ঠ আর দৃষ্টিকোনের দরকার আছে, এবং আপনারটাও তারমধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আমি আপনাকে যেটা দেখানোর চেষ্টা করছি সেটা হলো ফোন বা ক্যামেরা সবসময় হাতে রাখার দরকার নেই। আমি আপনাকে যেটা করতে উৎসাহী করতে চাচ্ছি সেটা হলো এক মূহুর্তের জন্য ফোন বা ক্যামেরা দূরে রাখুন-- সেটা আপনার নিজের মূহুর্ত। চলুন আবার ফেরত যাই মেসা আর্চে, পাথরগুলো যেভাবে কমলা আভা দেয়, এবং এর পটভূমিতে ভালোবাসাময় নীল স্তরগুলো। যদি এমন হয় পরেরবার আপনি মনোমুগ্ধকর কোন জায়গায় ছিলেন, এবং আপনি ক্যামেরা বা ফোন আনতে পারলেন না? অথবা ছবি তোলা একেবারেই মানা? এটা কি বাধার মত মনে হবে? নাকি স্বস্তি দিবে? তো আমরা কি করতে পারি? এমন করতে পারি যে যখন ফোন বা ক্যামেরা বের করার প্রয়োজন অনুভব করবো অথবা, আমার ক্ষেত্রে, যখন আমি বের করেই ফেলেছি (হাসি) প্রথমেঃ থামুন। বিরতি দিন। একটি গভীর নিশ্বাস নিন। চারপাশে তাকান। কি চোখে পড়লো? আপনি কি অন্য কা্রো সাথে মুহুর্তটা অনুভব করছেন? মনে রাখুন এই মূহুর্ত মাত্র একবারই আসে। আলোকচিত্রবিদ্যা একটি সুন্দর অভিজ্ঞতার অংশ হতে পারে। শুধু এটিকে বাস্তবতা আর আপনার মধ্যে বাধা হতে দেবেন না। অভিপ্রেত হোন, যেন একটি সুন্দর, অপূরনীয় স্মৃতি হারিয়ে না যায়, কারণ আপনি ছবিটা ঠিকমত তুলতেই বেশি মগ্ন ছিলেন। ধন্যবাদ। (করতালি)