এক মুহূর্তের জন্য ভাব যে তুমি এক ভয়ংকর যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিক।হয়ত কোন রোমান পদ-সৈনিক বা মধ্যযুগের তীরন্দাজ বা হয়ত কোন জুলু যোদ্ধা। একটি ব্যাপার স্থান-কাল ভেদে ধ্রূব। তোমার অ্যাড্রেনাল বেড়ে আছে, তোমার কাজ নিয়ন্ত্রিত কিছু গভীর বদ্ধমূল প্রতিবর্তী ক্রিয়া দ্বারা যা তোমার শত্রূকে হারাতে ও তোমাকে বাঁচাতে দরকার। এখন, নিজেকে অন্য এক ভূমিকায় ভাব, ভাব তুমি স্কাউট। স্কাউটের কাজ কাউকে আক্রমন করা/ নিজেকে বাঁচানো না। স্কাউটের কাজ বোঝা। স্কাউট বের হয়, ভূমির ম্যাপ তৈরি করে সম্ভাব্য সমস্যা চিহ্নিত করে। স্কাউট শেখার আশা করে, যেমন কোন ব্রীজ আছে কিনা, সুবিধামত জায়গায়- নদীর ধারেই। তবে স্কাউট আসলে নির্ভুল ভাবে জানতে চায় বাস্তব সত্য জানতে চায়। আর্মিতে সৈনিক ও স্কাউট- দু'টিই দরকার। এ ভূমিকাদের আমাদের মানসিকতা হিসেবে ভাবা যায়-এক রূপক হিসেবে যে কিভাবে পাই প্রাত্যহিক জীবনের তথ্য ও ধারণা আমি আজ যা বলতে চাই- সঠিক বিচার করতে, অনুমান করতে, ভাল সিদ্ধান্ত নিতে যা লাগে তা হল তোমার মানসিকতা কি ধরণের। বাস্তব উদাহরণ দিতে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি ১৯ শতকের ফ্রান্সে। যেখানে এক বিরাট রাজনৈতিক স্ক্যান্ডালের সূচনা করেছিল সাধারণ দেখতে এ কাগজের টুকরাটি। ১৮৯৪ সালে ফ্রেঞ্চ জেনেরাল স্টাফরা তা আবিষ্কার করেছিল এটা ময়লার বাক্সে ছেড়া পড়ে ছিল, তারা যখন তা জোড়া লাগালো, আবিষ্কার করল, তাদের র্যাঙ্কের কেউ জার্মানীতে আর্মির গোপন তথ্য বিক্রি করছে। তাই তারা বিশালাকারে তদন্ত শুরু করল, আর তাদের সন্দেহ খুব দ্রুত এই লোকের উপর হল, আলফ্রেড ড্রাইফাস। তার রেকর্ড খুব ভাল ছিল, অতীতে খারাপ কাজ নেই, কোন সূত্র নেই বলার মত। সে ছিল একা ইহুদি অফিসার আর্মি র্যাঙ্কে। তখন ফ্রেঞ্চ আর্মি ভীষণ ইহুদি-বিরোধী ছিল। তারা ড্রাইফাসের হস্তাক্ষর এক মেমোর সাথে মেলালো ও সিদ্ধান্ত নিল তা মিলে গেছে। যদিও হাতের লেখা বিশারদ তাতে তত আত্নবিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু সেটা ব্যাপার না। তারা ড্রাইফাসের বাড়ি গেল ও খুঁজলো নজরদারির কোন চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা। তারা তার ফাইল দেখল কিন্তু কিছুই পেল না। তারা ভাবল ড্রাইফাস শুধুই অপরাধী না, চালাকও কারণ তারা যাওয়ার আগেই সে সব প্রমাণ লুকিয়ে ফেলেছে। এরপর, তারা তার ব্যক্তিগত ইতিহাস ঘাটল যদি তাকে অপরাধী প্রমাণ করা যায়। তারা তার শিক্ষকদের সাথে কথা বলল, জানলো সে বিদেশী ভাষা শিখেছে, মানে জীবনে অন্য সরকারের সাথে ক্ষতিকর কিছু করার নিশ্চিত ইচ্ছা। শিক্ষকেরা বলল, তার স্মরণশক্তি খুব ভাল ছিল এসব খুব সন্দেহজনক, তাই না? কারণ গুপ্তচরকে বেশ কিছু জিনিস মনে রাখতে হয়। তাই মামলার কাঠগোড়ায় ড্রাইফাস অপরাধী সনাক্ত হল। তাকে পাবলিক স্কয়ারে নিয়ে যাওয়া হল, প্রথা অনুসারে ইউনিফর্ম থেকে পদাঙ্ক খোলা হল তার তলোয়ার ভেঙ্গে দু'টুকরো করা হল। ড্রাইফাসের পদাবনতি হল। তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হল দক্ষিন আমেরিকার সাগরতীরে শয়তানের দ্বীপে। সে ওখানে গেল, সারাদিন একা থাকল, চিঠির পর চিঠি লিখল ফরাসি সরকারকে, কেস আবার খুলতে বলল যেন তারা বুঝতে পারে সে নিরপরাধ ছিল। ফ্রান্সে তা ছিল সমাপ্ত কেইস। আমার ভাবতে অবাক লাগে, ড্রাইফাসের কেস এ অফিসারেরা কেন এত নিশ্চিত ছিল যে ড্রাইফাসই অপরাধী ছিল। তুমি ভাবতে পারো, তারা সব বানিয়েছে যে তাকে ইচ্ছা করে অপরাধী বানাতে। ইতিহাসবিদেরা তা মনে করেন না। যতদূর জানি, অফিসারেরা ভাবত ড্রাইফাসের বিরুদ্ধে কেস শক্ত ছিল। যা তোমাকে ভাবাতে পারেঃ আসলে মানব মনে কি এমন অভেদ্য প্রমাণ থাকে যা কাউকে অপরাধী চিহ্নিত করে বাধ্য করে? বিজ্ঞানীরা একে বলে,''উদ্দেশ্যমূলক যুক্তি'' যখন আমাদের অবচেতন প্রেষণা, চাহিদা ও ভয়, তথ্যকে আমাদের মত করে ভাবতে সাহায্য করে। কিছু তথ্য, কিছু ধারণাকে আমাদের পক্ষের মনে হয় আমরা সেসব জেতাতে চাই, সেসব রক্ষা করি। আর অন্য তথ্য বা ধারণা গুলো শত্রূ হয়ে যায়, ওগুলোকে আমরা বাদ দিতে চাই। তাই আমি উদ্দেশ্যমূলক যুক্তিকে বলি ''সৈনিক মানসিকতা'' তোমরা হয়ত কোন ফ্রেঞ্চ-ইহুদি অফিসারকে অপরাধী করনি, আমার মনে হয়, কিন্তু অনেক খেলা দেখ, বা রাজনীতিতে দেখেছ যে তোমার টিমকে যখন রেফারি বলে যে ফাউল করেছে তুমি অনেক কারণ খোঁজ যে কেন রেফারি ভুল। কিন্তু রেফারি অন্য টিমকে বিচার করলে তুমি বল- ভাল হয়েছে। এটা একটা কাছাকাছি উদাহরণ হতে পারে। বা তুমি হয়ত একটা আর্টিকেল পড়েছ যা কিছু বিতর্কীয় নীতি পরীক্ষা করেছে যেমন মৃত্যুদন্ড। গবেষকেরা বলে, তুমি যদি মৃত্যুদন্ড সমর্থন কর কিন্তু প্রবন্ধে বলা আছে, মৃত্যুদন্ড কার্যকরী উপায় না তবে তোমার উদ্দেশ্য হবে প্রবন্ধটি দুর্বল- এর কারন খোজা।কিন্তু যদি প্রবন্ধ বলে, মৃত্যুদন্ড আসলে কাজ করে, বলবে এটা ভাল স্টাডি। যদি মৃত্যুদন্ড সমর্থন না কর, তবেও তা। আমরা কোন পক্ষকে জেতাতে চাই তার উপর আমাদের বিচারক্ষমতা অবেচতন ভাবে গভীরভাবে প্রভাবিত, এটা সার্বিক এটা আমাদের স্বাস্থ্য-ভাবনা, সম্পর্ক, কাকে ভোট দিব, কি সঠিক বা নৈতিক সবই নিয়ন্ত্রণ করে। উদ্দেশ্যমূলক যুক্তি বা সৈনিক মানসিকতার যা আমার কাছে ভয়ংকর লাগে এটা আসলেই কতটা অবচেতন। আমরা ভাবি আমরা নৈব্যক্তিক ও শুদ্ধ মনের তাও কোন নিরপরাধ লোকের জীবন নষ্ট করতে পারি যাহোক, ড্রাইফাসের গল্প এখানেই শেষ না ইনি হলেন কর্ণেল পিকার্ট। ফ্রেঞ্চ আর্মির আরেক উচু র্যাংকের অফিসার সেও ভাবত ড্রাইফাস অপরাধী,আর্মির অন্যদের মত সে ভাবত সে কার্যকারণ গত ভাবে অপরাধী কিন্তু একসময় তার সন্দেহ হলঃ আমরা যদি ড্রাইফাসের বিষয়ে সবাই ভুল হই? যদি ড্রাইফাসের জেলে থাকলেও যদি জার্মানীর পক্ষে স্পাইং এর প্রমান পাওয়া যায়? আরও আবিষ্কার হল যে আরেক অফিসারের হাতের লেখা একেবারে মেমোর সাথে মিলে গেছে ড্রাইফাসের লেখার চেয়েও বেশী সে তার উর্ধ্বতনদের এ বিষয়ে জানালো তারা মানল না , তারা তাদের মতের পেছনে যৌক্তিকতা দিল আর্মিতে অন্য কেউ ড্রাইফাসের হাতের লেখা নকল করতে শিখেছে সে ড্রাইফাসের পরে স্পাইং করতে শুরু করেছে ড্রাইফাস তাই এখনও অপরাধী। পিকার্ট ড্রাইফাসকে নিরপরাধ প্রমাণ করেছিল ১০ বছরে সেই সময়ের কিছুটা সেও জেলে ছিল আর্মির প্রতি অবিশ্বাসী কাজের জন্য অনেকেই বলে এ গল্পের নায়ক পিকার্ট নয় কারণ সে জিউ-বিরোধী, যা আমিও মনে করি। ব্যক্তিগতভাবে, আমি মনে করি পিকার্ট প্রশংসনীয় তার জিউশ-বিরোধিতার জন্য কারণ তারও পক্ষপাতী হওয়ার কারণ ছিল অন্য অফিসারের মতই কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল সত্য খোজার যা সব ছাড়িয়ে গেছে। তাই আমার মতে পিকার্টের আছে 'স্কাউট মানসিকতা', তা হল কোন ধারণা জেতানো বা অন্য ধারণা হারানো না বরং সত্য যা শুধু মাত্র তা-ই দেখতে চাওয়া যতটা সম্ভব সৎ ও নিখুত ভাবে,তা সুন্দর, প্রীতিকর বা সুবিধামত নাও হতে পারে এ মানসিকতার প্রতি আমি ব্যক্তিগতভাবে আসক্ত স্কাউট মানসিকতা কি কারণে হয়-গত কয়েক বছর আমি পরীক্ষা করেছি কেন কিছু মানুষ অন্তত কিছু সময় পূর্বধারণা/ পক্ষপাতিত্ব ও উদ্দেশ্য থেকে বেরিয়ে এসে ফ্যাক্ট বা প্রমাণগুলোকে নৈবর্ক্তিকভাবে দেখতে চায়? উত্তর হল- আবেগিক। সৈনিক মানসিকতা নিজের ভাবনা রক্ষা করার মধ্যে আছে, স্কাউট মানসিকতাও তাই। তবে তাই। তবে তা ভিন্ন আবেগের মধ্যে নিহিত। যেমন, স্কাউট জানতে কৌতুহলী।তাদের ভাল লাগে তাদের ভাল লাগে যখন তারা নতুন কিছু জানে বা ধাপে ধাপে কোন ধাধার সমাধান করে তাদের পূর্ব ধারণা যখন ভুল হয়ে যায় তারা তখনও কৌতুহলি থাকে তাদের মূল্যবোধও ভিন্ন তাদের মতে নিজের বিশ্বাস ঝালিয়ে নেয়াই উত্তম ঝালিয়ে নেয়াই উত্তম তারা বলে না- যারা নিজের মন পরিবর্তন করে তারা দুর্বল এসবের উপরে, স্কাউটরা ভারসাম্যে রাখে। মানে,তারা কতটা সঠিক বা ভুল তার সাথে তাদের নিজস্ব মূল্যে জড়িত না তাদের বিশ্বাস হতে পারে, মৃত্যুদন্ড ভাল গবেষণায় যদি তা না পাওয়া যায়, তারা বলে 'ওহ্। আমি ভুলও হতে পারি। এর মানে এই না যে আমি খারাপ বা বোকা।'এ ধরণের বৈশিষ্ট্য থেকে গবেষকেরা বলে যা আমিও পেয়েছি- ভাল বিচার পাওয়া যায়। এখান থেকে যা নিতে পার- এই বৈশিষ্ট্য দ্বারা তুমি কত স্মার্ট বা তুমি কত জানো তা বলে না। এদের সাথে আই কিউ এর সম্পর্ক নেই এরা হল বরং তুমি কি অনুভব কর। আমি সেইন্ট-এক্সপেরীর কাছে ফিরতে চাই 'দ্য লিটল প্রিন্স' এর লেখক। তিনি বলেন, ''যদি তুমি একটা জাহাজ বানাতে চাও, অন্যদের কিছু কাঠ জোগাড় করতে বলোনা, আদেশ দিও না, কাজ ভাগ করে দিও না, বিশাল ও অন্তহীন সাগরের প্রতি আকুল হতে বল'' অন্য কথায়, আমি বলব, নিজেদের বা সমাজের বিচারক্ষমতা উন্নত করতে , আমাদের সবচেয়ে যা দরকার তা যুক্তি, উপমা, সম্ভাব্যতা, অর্থনীতি নয়, যদিও ওসবের গুরুত্ব আছে। আমাদের বেশী দরকার স্কাউট মানসিকতার নীতি প্রয়োগ করা আমরা যেভাবে অনুভব করি তা পরিবর্তন করে শেখা প্রয়োজন -লজ্জ্বিত না হয়ে গর্ব করতে যখন দেখি আমরা ভুল ছিলাম কোন বিষয়ে।শিখতে হবে কিভাবে আত্মরক্ষামূলক না হয়ে কৌতুহলি থাকা যায়, যখন বিশ্বাসের বিপরীত তথ্য পাই যে প্রশ্ন আমি তোমাদের করতে চাইঃ কি তোমার কাছে সবচেয়ে আকাঙ্খিত? তুমি শুধু নিজের বিশ্বাস রক্ষায় আকুল? নাকি এ পৃথিবী পরিষ্কারভাবে দেখতে আকুল? ধন্যবাদ। (হাততালি)