বিচিত্র ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের এক বিশ্বের কথা চিন্তা করুন। যেখানে রয়েছে ঘন বায়ুমণ্ডল যার মধ্য দিয়ে বাতাস বয়ে চলে এবং বৃষ্টি পড়ে। যেখানে রয়েছে পাহাড় এবং সমতল, নদী, হ্রদ এবং সমুদ্র বালিয়াড়ি এবং কিছু আগ্নেয়গিরির মুখ। পৃথিবীর মতোই শোনাচ্ছে, তাই তো? এইটাই টাইটান। ১৯৮১ সালের আগস্টে, ভয়েজার ২ শনির সবচেয়ে বড় চন্দ্রের এই চিত্রটি ধারণ করে। ভয়েজার ২ এর মিশনগুলো আগের চেয়ে অনেক দূর এগিয়েছে, যা কিনা সৌরজগত এবং এর অদূরে যা আছে সেসবকে আমাদের ভূগোলবিদ্যার একটি অংশ করে তুলেছে। তবে এই চিত্রটি, এই ঝাপসা চন্দ্রটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে ঠিক কতটুকু রহস্য বাকি রয়েছে। যেই ভয়েজার এর কাছে গেলো তখনই আমরা এর ব্যাপারে বিস্তর জানতে পারলাম, তবে তারপরও আমরা জানতাম না যে এর বায়ুমণ্ডলের গভীরে কি লুকিয়ে রয়েছে। তবে কি এর ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যৈ রয়েছে বরফের বহির্ভাগ যা কিনা শনি এবং জুপিটারের বাকি সব চন্দ্রের মধ্যেও দেখা গেছে? অথবা শুধুমাত্র তরল মিথেনের একটি সুবিশাল মহাসাগর? অস্পষ্ট ধোঁয়াশা দ্বারা আচ্ছন্ন টাইটানের বহির্ভাগ ছিলো একটি বিরাট, রোমাঞ্চকর রহস্য যা উন্মোচন করতে ১৯৯৭ সালে কক্ষপথ পরিক্রমাকারী জুটি কাসিনি-হয়গেন্স তৈরি করা হয়। ২০০৪ সালে আগমনের পর, কাসিনি টাইটানের বহির্ভাগ থেকে যে প্রথম চিত্রগুলো পাঠায় তা শুধুই সম্মোহন বাড়িয়ে দেয়। আমাদের মাসের পর মাস লেগে গেলো বুঝতে যে আমরা এর বহির্ভাগে কি দেখছি, কি নির্ণয় করছি, যেমন, এর গাঢ় সমীরেখা, যা এতোই অজানা ছিলো যে আমরা সেগুলোকে বিড়ালের আচঁড় বলে সম্বোধন করতাম, যা কিনা আসলে ছিলো জৈব বালির তৈরি টিলা। কাসিনি এই তেরো বছরে শনি এবং এর চন্দ্র ও বলয় পরীক্ষা করায় আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিলো প্রায় অজ্ঞাত টাইটান পৃষ্ঠ সম্পর্কে জানার, এর ভূতত্ত্ব বোঝার, এর বায়ুমণ্ডল এর পৃষ্ঠতল গঠনে কি ভূমিকা রাখে তা জানার, এমনকি কিঞ্চিত পরিমাণ হলেও এর পৃষ্ঠতলের গভীর রহস্য ভেদ করার। সত্যিই, টাইটান হচ্ছে অনেক সমুদ্র বিশ্বের মধ্যে একটি, গ্রহাণু বেল্ট এবং মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথের অদূরে বাহ্যিক শীতল সৌরজগতে রয়েছে এর চন্দ্র যে পৃষ্ঠের তলদেশে আছে প্রচুর তরল - একটি জলীয় মহাসাগর। টাইটানের অভ্যন্তরীণ সমুদ্রে দশগুণ পর্যন্ত তরল জল থাকতে পারে যা কিনা পৃথিবীর সমস্ত নদী, হৃদ, সমুদ্র এবং মহাসাগর মিলিয়ে। এবং টাইটানের বহির্ভাগেও রয়েছে তরল মিথেন এবং ইথেনের অদ্ভুত সুন্দর সব হৃদ ও সমুদ্র। সমুদ্রপৃষ্ঠ হচ্ছে সৌরজগতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাগুলোর মধ্যে একটি, এবং আমরা কেবলই এর আবিষ্কার করতে শুরু করেছি। এটি হচ্ছে ড্রাগনফ্লাই। জন হপকিন্স আ্যপলাইড ফিজিক্স ল্যাবরেটরিতে, আমরা এই মিশনটি তৈরি করছি নাসার নতুন ফ্রনটিয়ার্স প্রোগ্রামের জন্য। ২০২৬ সালে এটি যাত্রা শুরু করবে এবং ২০৩৪ সালে টাইটানে পৌঁছাবে, ড্রাগনফ্লাই একটি রটারক্রাফট ল্যান্ডার, যা কিনা মার্স রোভার্সের প্রায় সমান অথবা একটি ছোট গাড়ির সমান। টাইটানের অখণ্ড বায়ুমণ্ডল, এবং এর অধিক কম মাধ্যাকর্ষণ, এটি উড়ার জন্য একটি দারুণ জায়গা, আর ঠিক এর জন্যই ড্রাগনফ্লাইকে ডিজাইন করা হয়েছে। প্রযুক্তিগতভাবে এটি একটি অক্টোকপটার, ড্রাগনফ্লাই একটি চলনশীল পরীক্ষাগার যা কিনা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়তে পারে তার বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামসহ। ড্রাগনফ্লাই টাইটানকে বিস্তারিত ও অনন্যভাবে পরীক্ষা করবে, এর আবহাওয়া এবং ভূতত্ত্বকে বিশদ জানবে, এমনকি এর পৃষ্ঠ থেকে নমুনাও সংগ্রহ করবে যেন জানতে পারে যে তা কি দিয়ে তৈরি। সবকিছু ঠিক থাকলে ড্রাগনফ্লাই টাইটানে প্রায় তিন বছর কাটাবে, এর বিশদ গ্রহ রসায়ন মাপবে, পর্যবেক্ষণ করবে বায়ুমণ্ডল এবং কিভাবে তা পৃষ্ঠতলের সাথে সমন্বয় ঘটায়, এমনকি ভূমিকম্পও ধারণ করবে, অথবা যাকে টাইটান ভূতত্ত্বে পারিভাষিকভাবে বলা হয় টাইটানকম্প। ড্রাগনফ্লাই টিমে, উত্তর আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের শত শত মানুষ, এই মিশনের নকশা ও প্রস্তুতিতে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে, একটি রোটরক্রাফট তৈরি করা, এর স্বয়ংক্রিয়ভাবে পথ পাড়ি দেয়ার পদ্ধতি এবং এর যন্ত্রাংশ তৈরি করা, যার সবই একসাথে কাজ করতে হবে টাইটানের বহির্ভাগে যেন সব বৈজ্ঞানিক পরিমাপ মেলে। ড্রাগনফ্লাই আমাদের অসাধারণ প্রাকৃতিক পরীক্ষাগার অভিযানের পরবর্তী ধাপ। উড়ার সময়, ভয়েজার কিছু সম্ভবনার জানান দেয়। এক দশকের বেশি সময় ধরে টাইটানের বায়ুমণ্ডলে অবতরণ করার পর এবং শনিকে প্রদক্ষিণ করে, কাসিনি আর হয়গেন্স টাইটানের থেকে রহস্যের পর্দা হঠাতে সক্ষম হয়। ড্রাগনফ্লাই টাইটানের পরিবেশে থাকবে, যেখানে, এই অবধি, আমাদের সবচেয়ে কাছে থেকে দেখা হচ্ছে এই চিত্রটি যা হয়গেন্স প্রোব ২০০৫ সালের জানুয়ারীতে তোলে। বহুভাবে, টাইটান হচ্ছে আদি পৃথিবীর নিকটতম পরিচিত সদৃশ উদাহরণ, জীবন বিকশিত হওয়ার আগের সেই পৃথিবীর। কাসিনি-হয়গেন্সের পরিমাপ থেকে, আমরা জানতে পারি যে জীবনের উপকরণ অন্তত যে জীবনকে আমরা চিনি, তা টাইটানে উপস্থিত আছে, এবং ড্রাগনফ্লাই এই ভিনদেশী পরিবেশে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিযুক্ত করবে, এমন সব মিশ্রিত পদার্থের খোঁজে যা কিনা পৃথিবীর জীবনকে বিকশিত করতে সহায়তা করে থাকতে পারে এবং অন্যান্য জগতের বসবাসযোগ্যতা সম্পর্কেও আমাদের শেখাতে পারে। বসবাসযোগ্যতা একটি অসাধারণ বিষয়। একটি পরিবেশকে হোস্ট লাইফের উপযোগী করে তুলতে কি কি প্রয়োজন, হোক সেটা যেমনটা কিনা আমরা পৃথিবীতে জেনে থাকি, অথবা সম্ভবত সেইসব অদ্ভুত সুন্দর জীবন যা খুবই বিরল পরিস্থিতিতে বিকশিত হয়েছে? অন্য কোথাও জীবনের সম্ভবনা মানুষের কল্পনাশক্তি ও অন্বেষণকে ইতিহাস জুড়ে উদ্বুদ্ধ করেছে। একটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে, এই কারণেই সৌরজগতের বাহ্যিক সামুদ্রিক বিশ্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই "তাহলে কি" মানব অন্বেষণকে অগ্রসর করেছে। আমরা জানি না কিভাবে গ্রহ রসায়ন পৃথিবীতে জীবতত্ত্বের দিকে অগ্রসর হয়েছিলো, তবে একই রকম রাসায়নিক প্রক্রিয়া টাইটানেও হয়ে থাকতে পারে, যেখানে জৈব রেণুর সুযোগ ঘটেছিলো উপরিভাগের তরল জলের সাথে মিশ্রিত হওয়ার। জৈব সংশ্লেষণের কি তবে এই পরিস্থিতিতে অগ্রগতি হয়েছিলো? এবং যদি হয়, তাহলে তা কতো দূর অবধি হয়েছিলো? আমরা তা জানি না... এখনও। আমরা ড্রাগনফ্লাই থেকে যা শিখবো, মূলত তা হলো এই যে , মানুষের এই প্রচেষ্টায়ই হচ্ছে মোহনীয়। এটি হচ্ছে আমাদের গঠনের খোঁজ, ভিতের খোঁজ, রাসায়নিক ক্রিয়ার খোঁজ, ঠিক সেইসব যা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে জীবনের সূচনা করেছিল। আমরা সঠিক জানিনা যে টাইটানে গেলে আমরা কি পাবো, তবে ঠিক এই কারণেই আমরা সেখানে যাচ্ছি। ১৯৯৪ সালে, কার্ল সেগান লিখেছিলেন, "টাইটানে স্বর্গ থেকে যে অমৃতের মতো রেণু বৃষ্টি ঝরছে, বিগত চার বিলিয়ন বছর ধরে এখনো সেখানে থাকতে পারে, অপরিবর্তিত, হিমায়িত। মূলত পৃথিবী থেকে আগত রসায়নবিদদের অপেক্ষায়।" আমরাই সেই রসায়নবিদ। ড্রাগনফ্লাই হচ্ছে একটি বৃহত্তর বোধগম্যতার খোঁজ, শুধুমাত্র টাইটান এবং আমাদের সৌরজগতের রহস্যেরই নয়, বরঞ্চ আমাদের নিজেদেরই উদ্ভবের। ধন্যবাদ।