কোরআনে স্বর্গ অর্থাৎ জান্নাতের কথা উঠলে
৭২ কুমারী কন্যার উল্লেখ
অনেকেই শুনেছেন নিশ্চয়,
তাদের নিয়ে পরে কথা হবে।
তবে তথ্য এটাই, যে কোরআনের স্বর্গের
যে বর্ণনা ৩৬ বার - 'স্রোতস্বিনি প্রবাহিকাদের
দ্বারা সিঞ্ছিত বাগান' - বলে দেয়া আছে,
আমাদের এই সুন্দর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল
অনেকটা সেই রকম। আমি যেহেতু লেক ইয়ুনিয়নের জলের উপর
হাউস-বোট এ থাকি,সেখানকার অপূর্ব সৌন্দর্যের মাঝে বসে
স্বর্গের এই বর্ণনা-র যথার্ততা মর্মে মর্মে অনুভব করি।
কিন্তু কেন বেশিরভাগ লোকেরাই কোরআনে দেয়া স্বর্গের বর্ণনা জানে না ?
ভালো মনে কোরআন পড়তে শুরু করা অনেক অ-মুস্লিমদের দেখেছি,
কোরআন পড়া শুর করেও তার সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের সাথে
খাপ খাওয়াতে না পেরে মাঝ পথেই হাল ছেড়ে দিতে।
ইতিহাসকার থমাস কার্লাইল মুহাম্মদকে
বিশ্বের মহানতম নায়কদের মধ্যে ফেলেন,
কিন্তু উনি ও কোরআন পড়া নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন -
'প্রচন্ড কঠিন কাজ, খটোমটো ,
দুর্বোধ্য ঘ্যাঁট।'
(হাসি)
আমার মনে হয়, এই সমস্যার একটা কারণ
কোরআনকে অন্য সকল বই এর মতোই
সহজে পড়ে ফেলার চেষ্টা --
কোনো বৃষ্টির দূপুরে, শুয়ে শুয়ে
পপ-কর্ন চিবোতে চিবোতে বই পড়া,
ভাবটা এমন, যেন ভগবান স্বয়ং -- মনে রাখবেন
কোরআন- পুরোটাই মুহাম্মদ কে বলা আল্লাহর বাণী --
যেন আর দশটা বেস্ট-সেলার লেখকের এর মতোই !
খুব কম সংখ্যক লোক
সত্যি কোরআন পড়েন বলেই
যেকেউ এবং সকলেই কোরআন উদ্ধৃত করে,
যা বেশিরভাগ সময়েই ভুল।
কথার টুকরো তুলে, ভেংগে-চুরে,
নিজের 'সুবিধে মতো অর্থ' পেশ করা
গোঁড়া কাঠ-মোল্লারাও প্রায়-ই করে থাকেন,
আর কট্টর ইস্লাম-বিরোধিরাও।
এবার বলি গত বসন্তের কথা,
আমি মুহাম্মদ-এর জীবন-কাহিনী
লেখা শুরু করতে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হলো,
আগে আমার কোরআনটা ঠিক করে পড়া উচিৎ
মানে যতটা আমার সাধ্যে কুলায় আর কী!
আমার আরবী-জ্ঞান
ডিক্সনারী নির্ভর,
তাই আমি চারটে নাম-করা অনুবাদ
পাশা-পাশি ফেলে পড়বো ঠিক করলাম,
প্রতিটা ছন্দ,
তাদের উচ্চারণ আর মুল সপ্তম শতাব্দীর
আরবী সংস্করণ সংগে রেখে।
আমার একটা সুবিধে ছিল।
আমার আগের বই টা শিয়া-সুন্নী বিভেদ নিয়ে ছিল,
তাই সে সময় ইস্লামের প্রাচীনতম ইতিহাস নিয়ে
আমায় প্রচুর চর্চা করতে হয়েছিল।
ফলেই, কোরআনে ঘুরে ফিরে বার বার
উল্লেখিত ঘটনাগুলো আমার
মোটামুটি জানা ছিল।
আমার জ্ঞানের দৌড় যতটুকু ছিল, তাতে
কোরআন চর্চায় আমার স্থান এক বহিরাগতের মতো ছিল,
যে কিছুটা জানে,
কিছুটা অভিজ্ঞতাও রাখে,
কিন্তু শেষ-মেশ, একটা বাইরের লোক,
এক অবিশ্বাসী ইহুদী,
যে কিনা অন্যদের ধর্ম-গ্রন্থ পড়ার চেষ্টা করছে!
(হাসি)
আমি তাই আস্তে আস্তে পড়া শুরু করলাম।
(হাসি)
আমি এই কাজের জন্য তিন সপ্তাহের সময় ধার্য করেছিলাম,
অতি আত্মবিশ্বাসের চমৎকার নিদর্শন --
(হাসি)
-- কারণ তিন সপ্তাহ গিয়ে ঠেকল তিন মাসে।
ছোট আর বেশী রহস্যবাদী অধ্যায়গুলো আগে-ভাগে
চট করে পড়ে নেওয়ার প্রলোভন পাশ কাটাতে হয়েছিল।
কিন্তু যেই না মনে হতো, যে, হ্যাঁ,
এবার কোরআন এর মর্মে পৌঁছতে পারছি,
এবার ব্যাপারটা আয়ত্তে আসছে--
পরদিনই সেই ভাবটা ছু হয়ে যেত,
আর সকালে বসে ভাবতাম,
আমি অচেনা, কিন্ত তবু ও
খুব চেনা এক জগতে যেন হারিয়ে গেছি।
কোরান বলে, যে সে টোরাহ (ইহুদি ধর্ম-গ্রন্থ) আর
গস্পেল (খ্রিস্টান ধর্ম-গ্রন্থ) এর বাণী নতুন করে বলতে এসেছে।
তাই, কোরানের এক-তৃতীয়াংশ
বাইবেল এর নানা চরিত্র,
যেমন আব্রাহাম, মুসা, জোসেফ, মেরী
আর যিশু-র কাহিনী বলে।
ঈশ্বর নিজে, নিজের আগের ইয়াহ্য়া -র অবতারের
মতোই, ইর্ষাপরায়ণ জোরের সঙ্গে
অন্য আর কোন ঈশ্বর নেই, সাব্যস্ত করেন।
ঊঁট, পাহাড়, মরুভুমির
কুঁয়ো আর ঝরণার উল্লেখ আমায়
সাইনাই মরভুমি ঘুরতে ঘুরতে
কাটানো বছরটার কথা মনে পড়িয়ে দিছ্ছিল।
আর সেই ভাষা, তার সুরেলা ছন্দ
সেই বিকেলগুলোর কথা
মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল, যখন বসে বসে
বেদূইন বুড়োদের মুখে, বেশ কয়েক ঘন্টা লম্বা
মুখস্ত কাব্য কাহিনী শুনতাম।
আর আমি তখন বুঝলাম
কেন বলা হয়, যে
কোরআন কে কোরআনের মতো জানতে হলে
কোরআন কে আরবী তে জানতে হবে।
ধরুন, ফাতিহাহ্ এর কথাই নিই,
সাতটি আয়াতের প্রথম অধ্যায়, যা ঈশ্বরের এর প্রার্থনা ই শুধু নয়,
ইসলামের শেমা-ইস্রায়েল (প্রমুখ প্রার্থনা) ও বটে।
আরবীতে ফাতিহাহ্ মাত্র ২৯ শব্দের, কিন্তু অনুবাদের করলে
দেখা যায় এটা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ৬৫ থেকে ৭২ শব্দে,
আর তারপর ও, যত বেশী করেই না বলা,
ততই মনে হয় সব বলা হল না !
আরবী উচ্চারণ শৈলী
মন্ত্রমুগ্ধ করে দিতে পারে,
যেটা শুধু পড়ে বোঝা যাবে না, শুনতে হবে,
তর্কে তার্কীকতার চেয়ে অনুভুতির দরকার বেশী।
দরকার সস্বর উচ্চারণ করা,
যাতে এটার সংগীত জীভ আর কান ছুঁয়ে যেতে পারে।
তাই ইংরেজীতে কোরআন
নিজের ছায়া মাত্র, বা আর্থর আরবেরী
নিজের করা অনুবাদ নিয়ে যা বলেছিলেন,
'সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা।'
কিন্তু অনুবাদে সব যে হারিয়ে যায়, তা নয়।
কোরআনে যেমন বলা আছে, তেমনই, সবুরে মেওয়া ফলে।
অনেক আশ্চর্য করার মত জিনিষ ও আছে --
যেমন পরিবেশ নিয়ে একটু সচেতনতা, আর ঈশ্বরের সৃষ্টিতে
মানুষের নিমিত্ত মাত্র হওয়ার বোধ,
যার তুলনা বাইবেলে পাওয়া যায় না।
তাছাড়া যেখানে বাইবেল কেবলমাত্র পুরুষদের সম্বোধন করে,
কথ্যে ভাষ্য পুলিঙ্গ দ্বিতীয় আর তৃতীয় পুরুষ এ,
সেখানে কোরআন কিন্তু মহিলাদের ও উদ্দেশ করে--
যেমন কোরআন বলে
আস্থা রাখা পুরুষ আর আস্থা রাখা মহিলাদের কথা,
সম্মাlনীয় পুরুষ আর সম্মানীয়া মহিলাদের কথা।
বা কাফেরদের মারার
সেই কুখ্যাত আয়াতের কথাই ধরুন।
হ্যাঁ, আয়াত এটা বলে বটে,
কিন্তু একটা বিশেষ প্রসঙ্গেঃ
পবিত্র শহর মেক্কা
বিজয়ের প্রস্তুতিতে,
মেক্কা তে এমনিতে মার-পীট নিষিদ্ধ ছিল,
আর লড়ার এই অনুমতি ও অনেক নিষেধ এর সঙ্গে দেওয়া।
'মেক্কা তে কাফেরদের মারতেই হবে ' নয়, বলা আছে
'মারতে পারো, যদি তার অনুমতি থাকে,
কিন্তু রেয়াত এর মেয়াদ পুরো হয়ে গিয়ে থাকলে
এবং তখন ই, যদি কোনো সন্ধি স্থাপন না হয়ে থাকে
আর তাতে ও যদি ওরা তোমাদের কাবা যেতে বাধা দিয়ে থাকলে,
এবং তখন ই, যদি ওরা প্রথমে আক্রমণ করে ।
কিন্তু তারপরে ও - ঈশ্বর দয়াময়,
ক্ষমা করে দেওয়া ই শ্রেয় --
আর তাই, কার্যত,
না মারলেই ভাল।
(হাসি)
তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার --
কোরআন কতটা উদার,
মনে কট্টর গোঁড়ামি পোষন না
করে দেখলেই তা দেখা যাবে।
কোরআন বলে, 'কয়েকটি আয়াতের অর্থ সুস্পষ্ট,
আর কয়েকটির একাধিক অর্থ হতে পারে।'
কুটিল, কুচুটে লোকেরা
এই অস্পষ্টতাটার ই ফায়দা তোলে,
অশান্তি, লড়াই বাধিয়ে
নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে।
একমাত্র ঈশ্বর ই সঠিক অর্থ কী, জানেন।
'ঈশ্বর সুক্ষ্ম', এই কথাটি
(কোরআনে) বার বার ঘুরে ঘুরে আসে,
আর সত্যি কথা বলতে, আমাদের যতটা বোঝানো হয়,
কোরআন তার থেকে অনেক বেশী সুক্ষ্ম।
যেমন ধরুন,
সেই ছোট্ট বিষয়
কুমারী আর স্বর্গ নিয়ে।
এক্ষেত্রে প্রাচ্যের পুরোনো-পন্থী ধ্যান-ধারণার বিশেষ ভুমিকা আছে।
এই প্রসঙ্গে যে শব্দ চার বার ব্যবহার করা হয়েছে,
তা হল 'হুরী'
যা বোঝানো হয়
কাজল-নয়না ভারী বক্ষের কন্যা, অথবা
গৌর গাত্রবর্ণা ভারী নিতম্বের কুমারী বলে।
কিন্তু এ সব ব্যাখ্যান যে মুল আরবী শব্দ নিয়ে,
সেটা হল - 'হুরী'।
তাতে ভারী বক্ষ অথবা নিতম্ব তো কোথা ও নেই!
(হাসি)
কথাটার প্রয়োগ কিন্তু 'পবিত্র আত্মা", যেমন ধরুন
দেবদুত --বোঝাতে ও হয়ে থাকতে পারে --
অথবা গ্রীক কৌরস্ বা কোর এর মতো
চিরযৌবন এর প্রতীক হিসেবে।
তবে সত্যি এটাই, যে কেউ ই ঠীক জানে না,
আর আসল ব্যাপারটা তাই।
কারণ কোরাআন খুব স্পষ্ট বলে,
যে আপনি ' স্বর্গে নতুন
রুপ ধারন করবেন '
আর আপনার ' সম্পূর্ণ অচেনা কোন রুপে
আপনার পুনর্জন্ম হবে,'
আমার কাছে সেটা কিন্তু কোন কুমারী কন্যা পাওয়ার
থেকে বেশী আকর্ষক প্রস্তাব!
(হাসি)
আর হ্যাঁ ওই ৭২ এর সংখ্যা কোথাও নেই।
কোরানে ৭২ কুমারী কন্যা-র
উল্লেখ নেই।
এই ধারণাটা ৩০০ বছর পরে এসেছে,
আর বেশীরভাগ ইসলাম বোদ্ধারা
ওই যে মেঘের উপর হার্প হাতে বসে থাকা
লোকেদের খ্রীস্টান ধারনা-র মতোই মনে করেন।
স্বর্গ কিন্তু এর থেকে একেবারেই আলাদা।
স্বর্গ কৌমার্য্য নয়;
স্বর্গ উর্বরতা।
স্বর্গ প্রাচুর্য
(কোরআনে) স্বর্গ ছোট ছোট নদীর জলে
সিঞ্চিত বাগান।
ধন্যবাদ।
(হাত-তালি)